ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

পবিত্র অনুভূতির দোলনচাঁপা

যেন প্রজাপতির শুভ্র ডানা, মিষ্টি ঘ্রাণ

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২৪ আগস্ট ২০২১

যেন প্রজাপতির শুভ্র ডানা, মিষ্টি ঘ্রাণ

মোরসালিন মিজান ॥ দোলনচাঁপা মানেই মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। ঘ্রাণটা পাচ্ছেন তো? এখনই সময়। বৃষ্টির জলে ধুয়ে প্রিয় ফুলের পাপড়ি আরও সতেজ, আরও সাদা হয়েছে। দেখে নিজের ভেতরেও সজীব সতেজ একটা অনুভূতি হয়। আর মৃদু মন্দ হাওয়ায় দোলতে থাকা দোলনচাঁপার ঘ্রাণ, কী বলব, ঐশ্বরিক। ফুলের কাছেও যেতে হয় না। স্পর্শ করতে হয় না। অনেক দূর থেকে আপনি সে ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। ফুলপ্রেমীরা একে প্রকৃতির অমূল্য উপহার হিসেবেই গ্রহণ করেন। আবার দুর্ভাগার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। লক্ষ্য করবেন, বিকেল হতেই দোলনচাঁপা হাতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে ফুটপাথে ছোটাছুটি করছে পথশিশুরা। দোলনচাঁপার তোড়া সাজিয়ে ক্রেতা খুঁজছে তারা। যানজটে আটকাপড়া ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীর দিকে ফুলটি এগিয়ে দিয়ে কেনার অনুরোধ করছে। শুধু তো অনুরোধ নয়, এক ধরনের আকুতি। গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীদের অনেকেই এমনকি গ্লাসটি নামান না। মালিককে খুশি করতে ফুল বিক্রেতাদের তাড়ানোর সব চেষ্টা করেন গাড়িচালক। এভাবে দোলনচাঁপার মতো ফুলটি হাতের কাছে পেয়েও ঘ্রাণ নেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন অনেকে। যিনি কিনলেন না এ ফুল, ঘ্রাণটা শুঁকে দেখলেন না তাকে দুর্ভাগা ছাড়া আর কী-ই বা বলবার থাকে? আবার যারা কেনেন তাদের গাড়ি, ঘর ফুলের ঘ্রাণে এত ভরে ওঠে যে, মানিক্য দিয়ে মুড়িয়ে দিলেও তা সম্ভব নয়। পুরনো প্রাচীন সুখস্মৃতিকেও স্মরণ করিয়ে দিতে পারে দোলনচাঁপার ঘ্রাণ। কবে কখন কে আপনাকে দোলনচাঁপা উপহার দিয়েছিল, ঘ্রাণ নাকে আসলে তার কথাও নতুন করে মনে পড়ে যাবে। যাবেই। দোলনচাঁপা বর্ষার ফুল। বর্ষা বলতে, বর্ষার শেষভাগে এসেই বেশি ফোটে। এখন তাই বিশেষভাবে চোখে পড়ছে। সাদা রঙের পাপড়ি যারপরনাই হালকা। বৃষ্টির ঝিরি হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। দেখে মনে হয় শ্বেত শুভ্র প্রজাপতি। এক জায়গায় থেকে উড়ছে। ওড়ি ওড়ি ভাব। তাতেই ছড়িয়ে পড়ছে ঘ্রাণটা। এ কারণে ফুলটিকে বাটারফ্লাই জিঞ্জার লিলি নামেও ডাকা হয়। দোলনচাঁপার নাচন দেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : দোলে দোলে দোলে প্রেমের দোলন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে...। নজরুল নিজের মতো করে ফুলটির বর্ণনা দিয়েছেন। কবির ভাষায়, যেন দেবকুমারীর শুভ্র হাসি, ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি/ আরতির মৃদুজ্যোতি প্রদীপ কলি দোলে, যেন দেউল আঙিনাতে...। আর তসলিমা নাসরীন লিখছেন, আমার ভালবাসার কথা দোলনচাঁপা জানে/তাই এত সুগন্ধ ছড়ায়...। এবার প্রশ্ন, প্রেমিক পুরুষটি কি তার প্রিয়ার হাতে দোলনচাঁপা তুলে দেন? প্রেয়সী নিজে কি তার ভালবাসার মানুষের কথা ভেবে কেনেন এ ফুল? খুব কম। কেন যেন, প্রেম বিনিময়ে দোলনচাঁপার ব্যবহার অত দৃশ্যমান হয় না। তবে ফুলটির শুভ্র পাপড়ি ও ঘ্রাণে যে পবিত্র অনুভূতি হয় ভালবাসার অনুভূতির সঙ্গে তার মিল শতভাগ! নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা মতে, দোলনচাপা মূলত বুনো ফুল। আদিনিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। ভারতীয় প্রজাতির ফুল বহুকাল ধরে বাংলাদেশে আছে। এর প্রায় ৪০টির মতো প্রজাতি। কোনটির রং হলদেটে। কোনটি আবার লাল। তবে প্রধানত সাদা রঙের হয়। গাছ ৬০-৭০ সেমি পর্যন্ত উঁচু হয়। কান্ডের পাশে কয়েকটি লম্বা পাতা থাকে। দোলনচাঁপার পাতা লেন্স আকৃতির। লম্বায় ৮-২৪ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। চওড়ায় হয় ২-৫ ইঞ্চি। বর্তমানে বাংলাদেশে ফুলটির ভাল চাষ হয়। ফুলচাষীরা মৌসুমি ফুল হিসেবে দোলনচাঁপার চাষ করে থাকেন। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে বসন্ত পর্যন্ত গাছের উপরের অংশে ৬-১২ ইঞ্চি পুষ্পমঞ্জরি দেখা দেয়। দোলনচাঁপা গাছ দেখতে অনেকটা আদা বা হলুদ গাছের মতো। ফুল ফোটা শেষ হলে কান্ড শুকিয়ে যায়। তবে গোড়া থেকে আবার নতুন কান্ড জন্ম নেয়। সূর্যের আলো সরাসরি পড়ে না এমন জায়গায় ভাল জন্মে। ঢাকার কোন কোন বাড়ির সামনের বাগানেও দোলনচাঁপা দেখা যায়। সারা বছর ফুলহীন। পাতা সর্বস্ব। বর্ষা এলেই ফুল। অন্য এক চেহারা। বিকেলে ফোটা ফুল দিনের সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। এখন এই করোনাকালে যারা ভাল করে নিশ্বাস নিতে পারছেন না, শ্বাসকষ্টে ভুগছেন তারা দ্রুতই সেরে উঠবেন, দোলনচাঁপা নিশ্চয়ই তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

আরো পড়ুন  

×