শংকর কুমার দে ॥ পাক হানাদার বাহিনীর একাত্তরের পৈশাচিক নৃশংতা ও বর্বরতাকেও হার মানিয়ে দিয়েছে হেফাজতের সন্ত্রাসের তা-বলীলা। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করার হেফাজতীদের উল্লাস নৃত্যে মেতে ওঠার ঘটনা স্মরণকালে আর দেখা যায়নি। সারাদেশে তিন দিন ধরে হেফাজতের বিক্ষোভ-হরতালের নামে নাশকতা, নৈরাজ্যে চালিয়েছে কোন কোন এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে হেফাজত। হেফাজতের তিন দিনের নারকীয় সন্ত্রাসের ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ, ভিডিওফুটেজ, বিভিন্ন টেলিভিশনের ফুটেজ ও ছবি দেখে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করছে পুলিশ। এতে বিএনপির নেত্রী নিপুণ রায় চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপির কর্মী আরমান হোসেনের অডিও উদ্ধার করা হয়েছে যাতে বাসে আগুন দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। জামায়াতের বাঁশের কেল্লায় ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সারাদেশে নাশকতা, নৈরাজ্য ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কর্মীদের নির্দেশ রয়েছে। হেফাজতের বিক্ষোভ-হরতালের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন লন্ডনে পলাতক ও সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান বানচাল করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতাকে সামনে এনে নাশকতা ও নৈরজ্যের সৃষ্টি করলেও স্বাধীনতার বিরোধিতা ও বঙ্গবন্ধুর অবমাননা করাই ছিল তাদের মূল টার্গেট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, হেফাজতের কর্মীরা লাঠিসোটা, খুন্তি, শাবল দিয়ে রাস্তায় থাকা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ভাঙছে। এই ভিডিও দৃশ্য সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। সুনামগঞ্জের শাল্লায় দরিদ্র হিন্দু পল্লীতে উস্কানি দিয়ে হামলা, ভাংচুর, লুটপাটের ঘটনার উস্কানিদাতাসহ দায়ীদের শক্ত হাতে মোকাবেলা করা হলে দেশব্যাপী সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর পুনরাবৃত্তি ঘটত না বলে উল্লেখ করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জে অন্তত এক ডজনের বেশি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। সারাদেশে এক ডজনের বেশি মামলায় আসামির সংখ্যা দশ সহস্রাধিক। এর মধ্যে কেবলমাত্র নারায়ণগঞ্জেই মামলা দায়ের করা হয়েছে অন্তত ছয়টি। এতে দেখা যায়, হেফাজতে ইসলামের তিন দিনের বিক্ষোভ-হরতালের তা-বে কেড়ে নিয়েছে ১৪ জনের তাজা প্রাণ। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষজন। সহায় সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে কোটি কোটি টাকার। এর মধ্যে বেশি সম্পদ নষ্ট হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রেলওয়ে, সরকারী স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির। এসব ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশ, র্যাব, সিআইডি ও গোয়েন্দা সংস্থা। অডিও, ভিডিও, ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এরপর হামলাকারী দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতে সারাদেশে ৩ দিন ধরে যে নাশকতা, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে তা পূর্বপরিকল্পিত নীলনক্সা অনুযায়ী। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা মুখে বললেও ভেতরে রয়েছে তাদের ভারত বিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর টার্গেট। হেফাজতের হরতালের সময়ে রাস্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য লাঠিসোটা, খুন্তি, শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে ভাঙ্গা হয়েছে, এমন দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হেফাজতের হরতালের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ভাঙ্গার সঙ্গে সম্পর্ক কি? গোয়েন্দা সংস্থা এসব ভিডিও ও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতের ডাকা হরতালের সময় বাসে আগুন ধরিয়ে সেই ভিডিও পাঠাতে কেরানীগঞ্জের স্থানীয় বিএনপি নেতা আরমানকে মুঠোফোনে নির্দেশ দেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরী। সেই নির্দেশনার অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে। এরপর হরতালে সহিংসতা সৃষ্টির জন্য প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায়কে আটক করেছে র্যাব। নিপুণ রায়ের নির্দেশনা পালনকারী কেরানীগঞ্জের স্থানীয় বিএনপি নেতা আরমানকেও গ্রেফতার করেছে র্যাব।
অডিও ক্লিপে নিপুণকে বলতে শোনা যায়, ‘একটা কিছু করা যাবে না? বাস হোক যেটাই হোক, ফুল ধরবে, ধরবে। একটু কাছ থেকে ছবি বা ভিডিও পাঠাবেন। অবশ্যই। অবশ্যই।’ ওপাশ থেকেও আরমান সম্মতি জানান। পরবর্তীতে স্থানীয় বিএনপি নেতা ও নিপুণ রায়ের অনুসারী আরমান ও খোরশেদ গাড়িতে আগুন ধরান এবং ছবি নিপুণের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। অডিও ক্লিপে আরও শোনা যায়, ‘ভিডিও পাঠাইতে পারি নাই, ছবি পাঠাইছি খালি। খালি ছবি পাঠাইছি। পুলিশ র্যাব।’ নিপুণ বলেন, ‘হোয়াটসএ্যাপে পাঠায় দেন। আমি জায়গা মতো পাঠায় দিব।’র্যাব আরও জানায়, নিপুণ রায়ের নির্দেশনার ফলে একটি বাসে আগুন লাগানো হয়েছে বলে তাকে জানায় শাহীন। কিন্তু পুলিশ চলে আসার কারণে ভিডিও করতে ব্যর্থ হন। এদিকে র্যাবের কাছে বিএনপি নেতা আরমান জানান, বিএনপি নেত্রী নিপুণ রায় গাড়ি পোড়ানোর এ ছবি দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পাঠাবেন। র্যাবের দেয়া তথ্যানুযায়ী, শনিবার (২৭ মার্চ) রাতে ও দিনে নিপুণ রায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কেরানীগঞ্জের বিএনপি নেতা আরমান, খোরশেদ ও শাহীন মালিবাগ ও সায়দাবাদে বাসে আগুন দেন বলে জানা যায়।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, হফাজতের ডাকা হরতালে ঢাকাসহ সারাদেশে অন্তত পাঁচ শতাধিক পোড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বিএনপি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অভিযানে বিএনপির এই নাশকতার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। বিএনপি নেত্রী নিপুণ একটি সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক কেরানীগঞ্জে বাস পোড়ানোর কাজ করেছেন। সেই সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান আরমানকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। হামলার ঘটনা স্বীকার করে আরমান জানান, শুধু কেরানীগঞ্জ নয় সমগ্র বাংলাদেশে বাস পোড়ানোর লক্ষ্য ছিল বিএনপির। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থানে তা সম্ভব হয়নি। র্যাবের পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সন্ত্রাসী আরমানের সঙ্গে মাত্র ৫ লাখ টাকায় ১০০ গাড়ি পোড়ানোর চুক্তি করে বিএনপি।