ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

কান্তিপদ রায়ের রসগোল্লা বাংলা ছাড়িয়ে ইউরোপে

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২০ জুলাই ২০১৯

কান্তিপদ রায়ের রসগোল্লা বাংলা ছাড়িয়ে ইউরোপে

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে ॥ রসে ভরা ছোট্ট একটি ছানার বল। যাকে আমরা বলি রসগোল্লা। বাংলা সাহিত্যে রসগোল্লাকে নিয়ে রচিত হয়েছে সরেস সাহিত্যকর্ম। বিশিষ্ট রম্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচনা করেছেন বিখ্যাত রম্যগল্প ‘রসগোল্লা’। সেই রসগোল্লা আজ বাংলা ছাড়িয়ে ইউরোপের বহু দেশে সমাদৃত হয়েছে। তবে রসগোল্লার আদি জন্ম নিয়ে অনেক কথাই শোনা গেলেও ইতিহাস বলছে রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল ছিল বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে। বিশেষ করে, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় পর্তুগীজদের সময় সেখানকার ময়রাগণ ছানা, চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে গোলাকার এক ধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করেন, যা ক্ষীরমোহন বা রসগোলা নামে পরিচিত ঝিল। পরবর্তীতে বরিশাল এলাকার হিন্দু ময়রাগণের বংশধর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা ও ওড়িশায় বিস্তার লাভ করেছিল। তবে এই রসগোল্লা তৈরি করে বাইসাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে আরেকটি ইতিহাস গড়ে তুলেছেন কান্তিপদ রায়। উত্তরবঙ্গের নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বাঙালীপুর ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামের মৃতঃ শিবকান্ত রায়ের ছেলে কান্তিপদ রায়। বয়স তার প্রায় ৮০ ছড়িয়ে গেছে। মনোবল এখনও শক্ত। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। দুই মেয়ে বিবাহিত আর ছেলেটি বিয়ের পর ব্রেন টিউমর আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ফলে ছেলের বউ নাতি-নাতনিদের নিয়ে দেখাশোনা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন তিনি। অনেক নামী-দামী দোকানের রসগোল্লাকে হার মানিয়েছে কান্তিপদের তৈরি রসগোল্লা। তার রসগোল্লার জনপ্রিয়তার একটি মাত্র কারণ নেই প্রচন্ড ক্ষতিকর রং বা কেমিক্যাল ও প্রকৃত ছানা দিয়ে তৈরি। তিনি রসগোল্লা তৈরি করেন সুজি, ছানা, দুধ দিয়ে। ছোট ছোট ছানার বল প্রথমে বানানো হয়। তারপর চিনির সিরায় সেগুলোকে রেখে কিছুক্ষণ ফুটিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করে নেন। গুড়ের রসগোলাও তৈরি করেন তিনি ঠিক একইভাবে। আসলেই রসগোল্লার নামটি শুনলেই এমনিতেই জিভে পানি চলে আসে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে যেখানে পাঁচ টাকা দিয়ে একটি চকোলেট বা এককাপ চা পাওয়া যায় না। সেখানে একই দামে রসগোল্লা খাওয়াচ্ছেন বৃদ্ধ কান্তিপদ রায়। তিনি বাড়িতে রসগোল্লা তৈরি করে বাইসাইকেলে নিয়ে গত ৬ যুগ ধরে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে বিক্রি করছেন এই রসগোল্লা। তার দেড় ইঞ্চি বৃত্তের সাইজের রসগোল্লাটি রসে মাখানো। অত্যন্ত সু-স্বাদু। যারা কান্তিপদ রায়ের তৈরি রসগোল্লা খেয়েছেন তারা বারবার তাকে খোঁজেন। এতে নীলফামারীর সৈয়দপুর শহর ও গ্রাম এলাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলার গ্রামে উপজেলার তরুণ-তরুণী, ছেলে-বুড়ো, কিশোর-কিশোরী, গৃহবধূ সবাই রসগোল্লা বিক্রেতা কান্তিপদের রসগোল্লার জন্য পাগল। তাই ওই সব এলাকার মানুষজনের বাসাবাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে তারা কান্তিপদ রায়কে খুঁজে নেন। অর্ডার করে তার কাছে রসগোল্লা ক্রয় করে নেন। সৈয়দপুর শহরের বাঙালীপুর নিজপাড়া মহল্লার গৃহবধূ পারুল বেগম (৩৪), রিনা আক্তার (২৬), নাজরীন পারভীন (৪৫) সালমা বেগম (৪২) জানান, কান্তিপদ রায়ের রসগোল্লা আমাদের বাসায় সব সময় থাকে। আত্মীয়স্বজন এলে দ্রুত এটা দিয়েই আমরা আপ্যায়ন করি। এতে অল্প ব্যয়ে মেহমানদারি হয়। এছাড়া বাচ্চারাও পছন্দ করে তাই কেনা চাই কান্তিপদ রায়ের সুস্বাদু রসগোল্লা। কান্তিপদের রসগোল্লা খেয়ে সৈয়দপুর শহরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে শেখ নিজাম উদ্দিন জানান, কান্তি দার রসগোল্লা বেশ সুস্বাদু, দামেও কম। তাই প্রায় দিনই বাসায় নিয়ে যাই। সেই কান্তিপদ এলাকার সকলের কাছে কান্তি দাদা নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। বৃদ্ধ কান্তিপদর স্ত্রী সুশিলা রানী (৭৫) বলেন, আমার শ্বশুরের আমল থেকে আমরা রসগোল্লা বিক্রি করি। প্রতিদিন কয়েক মণ মিষ্টি তৈরি করতাম। ছেলে মারা যাওয়ার পর আর্থিক অনটন ও নানা সমস্যায় পড়তে হয়। প্রতিদিন আমরা পরিবারে সকলে মিলে ৫০০ পিস করে রসগোল্লা তৈরি করি। রসগোল্লা তৈরিতে পরিবারের সকলে শ্রম দেয়ায় ব্যয় কম হয়। এতেই সামান্য দরে বিক্রি করলেও আমাদের লোকসান হয় না। এর আয় দিয়ে সবার ভরণ-পোষণ চলে। কান্তিপদ রায় বলেন, ছেলেটা যখন বেঁচে ছিল তখন সেই গ্রামে গ্রামে রসগোল্লা বিক্রি করত। ছেলে মারা যাওয়ার পর এখন সকাল ১০টায় বাইসাইকেলে করে শহর ও গ্রামের বিভিন্ন পাড়া মহল্লার অলি-গলি, সড়ক ও দোকানে এ রসগোল্ল বিক্রি করি। অনেকে পাইকারি নেয়। এভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রি করে বাসায় ফিরি। এতে প্রতিদিন খরচ বাদে ৭০০ থেকে ৮০০ শ’ টাকা লাভ হয়, যা পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ সহজে চলে যায়। তিনি আরও বলেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এ ব্যবসার শুরুতে এ মিষ্টির দাম অনেক কম ছিল। এর কাঁচামালের দাম বাড়ায় পর্যায়ক্রমে এর দাম বেড়েছে। তবে বিগত ২৫ বছর ধরে পাঁচ টাকায় মিষ্টি বিক্রি করছি। এ দর আর বাড়াইনি। প্রথমে আকারে বড় ছিল। এখন আকারে সামান্য ছোট করেছি। তবে চাহিদা কমেনি। তিনি বলেন, আমার বয়স বেড়েছে। নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি। যদি সরকারীভাবে সহজ শর্তে ঋণ পেতাম তাহলে আমার পরিবারে হাতে তৈরি রসগোল্লার একটি ছোট দোকান দিয়ে তাদের আয় রোজগারের স্থায়ীকরণ করতে পারতাম। সেই সঙ্গে তার এই রসগোল্লার ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ত বলে মনে করেন এ মিষ্টির কারিগর ও বিক্রেতা কান্তিপদ।

আরো পড়ুন  

×