ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য;###;ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে;###;আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর নজরদারির তাগিদ

ভেজালের মহামারী ॥ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ১০:৫০, ১৫ মার্চ ২০১৯

ভেজালের মহামারী ॥ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ

শাহীন রহমান ॥ সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে ভেজাল, নিম্নমানের খাবার, অনিরাপদ পানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভেজালের কারণে মানব স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। একটি সুস্থ জাতি গঠনে অবশ্য পালনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার আগে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। ভেজালের মহামারীর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে এখন থেকেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি রাজধানীর খাবারের মান পরীক্ষার জন্য একটি সমীক্ষা চালান। প্রাথমিকভাবে রাজধানীর ২শ’ হোটেল-রেস্তরাঁ বেছে নেয়া হয় পরীক্ষার জন্য। মাত্র ৫৭টির খাবার স্বাস্থ্যসম্মত বলে বিবেচিত হয়েছে। এর বাইরের অন্য সব রেস্তরাঁর খাবার ফুড গ্রেডের অনেক নিচে। সম্প্রতি হাইকোর্ট এক আদেশে বলেছে খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি বড় দুর্নীতি। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর মানুষের ব্যস্ততার কারণে প্রতিদিন ৬০ লাখ মানুষকে মধ্যাহ্নভোজসহ দিনে রাতে হোটেল-রেস্তরাঁর খাবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু মানুষ সচেতন এবং অসচেতনভাবেই নিম্নমানের খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছে। শুধু হোটেল-রেস্তরার নিম্নমানের খাবার নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যই ভেজাল বা বিষক্রিয়ার বাইরে নয়। এখানেই শেষ নয়, টেক্সটাইল রং মেশানো হচ্ছে বেকারি পণ্য, জুসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে। তেল, ঘি, আইসক্রিম, মিষ্টি, দই, ললিপপ, চকোলেট, কেক ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যেও ক্ষতিকর রং, ফ্লেভার ব্যবহার করা হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের ব্যবহার, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাদ্যপণ্য তৈরি, হোটেল-রেস্টুরেন্টে বাসি, মরা মুরগি, গরু, মহিষ, ছাগলের গোশত খাওয়ানোর ঘটনাও ঘটছে। আবার মিনারেল ওয়াটারের নামে ওয়াসার পানি বোতলজাত করে বাজারজাত করার ঘটনাও ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎস থেকে শুরু করে খাবার তৈরি এবং তা রক্ষণাবেক্ষণে নানা প্রক্রিয়ায় খাবারে ভেজাল মিশে যাচ্ছে। হোটেল-রেস্তরাঁয় বেশিরভাগ মিলছে অস্বাস্থ্যকর এবং নোংরা পরিবেশে। শুধু হোটেল-রেস্তরাঁর খাবার নয়, বিএসটিআইয়ের মান অনুসরণ না করায় উৎপাদিত পানিতে যেমন রয়েছে নানা ধরনের জীবাণু। মেয়াদোত্তীর্ণ অনেক পণ্যও হরহামেশা বিক্রি হচ্ছে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয় সুস্থ জীবন ও জাতি গঠনেও হুমকিস্বরূপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত এসব খাবার খেলে ভয়াবহ ক্রনিক রোগ হতে পারে। পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলে ক্যান্সার, আলসার, গ্যাস্ট্রিকসহ নানা রোগ হতে পারে। খাবারে যে কাপড়ের রং ব্যবহার করা হচ্ছে তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। শুধু খাদ্যে ভেজাল নয় ওজনে কম দেয়া এবং পণ্যের গায়ে উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদ না লিখেই পণ্য বাজারজাতকরণ চলছে। না জেনে এসব পণ্য কিনেও প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রত্যেক পণ্যের একটি মেয়াদ থাকে। এই মেয়াদের পরে সেই পণ্যের ব্যবহার স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সেই পণ্য ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। সম্প্রতি এই অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি গাজীপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে দেখতে পেয়েছে দই এবং মিষ্টির মতো প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রিতে ওজনে যেমন কম দিয়ে ঠকানো হচ্ছে ভোক্তাদের। আবার এর গায়ে মেয়াদ এবং উৎপাদনের তারিখও নেই। শুধু খাদ্য দ্রব্য নয়, জ্বালানি পণ্য এবং টেক্সটাইল দ্রব্যের ক্ষেত্রে একই চিত্র উঠে এসেছে। বিএসটিআইর এ সহকারী পরিচালক, মোঃ রেজাউল করিম বলেন, ওজন ও পরিমাণ মানদণ্ড আইন অনুযায়ী এসব অপরাধ দ-নীয়। বস্ত্রালয়ে কাপড় বিক্রিতে মিটারের পরিবর্তে গজকাঠি ব্যবহার করা অপরাধ। খাদ্যে ভেজালের পাশাপাশি মানুষের অতিপ্রয়োজনীয় পানির অনিরাপদ ব্যবহার চলছে। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মানহীন অনেক হোটেল-রেস্তরায় জারের পানির নামে যা ব্যবহার হচ্ছে তা উৎপাদনে তাদের কোন অনুমোদন নেই। বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া বিশুদ্ধ পানির উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ। কিন্তু অভিযানে দেখা গেছে এসব হোটেলে যেসব পানি ব্যবহার হচ্ছে তার কোন অনুমোদন বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে নেয়া হয়নি। অসাদু চক্র ওয়াসার পানি সরাসরি জারে ভর্তি করে বিক্রি করছে। সম্প্রতি ঢাকার সায়েদাবাদ, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ডেমরা রোড, মীর হাজিরবাগ ও শ্যামপুর এলাকায় [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশসংস্থাটির সার্ভিল্যান্স টিম অভিযান পরিচালনা করে লাইসেন্স ব্যতিরেকে বিক্রি হওয়া ড্রিংকিংওয়াটার নামের ১ হাজার ২শ’ পানির জার ধ্বংস করেছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এসব মানহীন পানি ব্যবহার না করতে পত্রিকায় বিপজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানো নিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি বড় দুর্নীতি। এ ধরনের ভেজালে মানুষের কিডনি, লিভার নষ্ট হচ্ছে। ক্যান্সার হচ্ছে। কোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, মানুষ এখন শুধু টাকার পেছনে ঘুরছে। দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে কেউ ভাবছেন না। ইতোমধ্যে রাজধানীর হোটেল-রেস্তরাঁর খাবারের মান পরীক্ষা করে তা গ্রেডিং সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসার ব্যবস্থা নিয়েছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন ২শ’ হোটেল-রেস্তরাঁর খাবারের মান পরীক্ষা করে মাত্র ৫৭টির মান স্বাস্থ্যসম্মত দেখা গেছে। পর্যায়ক্রমে রাজধানীর সব হোটেল-রেস্তরাঁর খাবার পরীক্ষা করে গ্রেডিং সিস্টেমের আততায় আনা হবে। মানের পরীক্ষায় ফেল হলে সেসব রেস্তরাঁ বন্ধ করে দেয়া হবে। ইতোমধ্যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় ৫৭টি রেস্তরাঁকে মান অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে। মানের মধ্যে এ প্লাস, এ গ্রেড, বি গ্রেড, সি অর্থাৎ উত্তম, ভাল মান, গড়পড়তা ভাল এবং অনিরাপদ খাদ্যে বিভাজন করা হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ভেজালবিরোধী এক অভিযানে দেখা গেছে ক্ষতিকর রং, তেল, সার জাতীয় ধরনের পদার্থের মিশ্রণে তৈরি করা হচ্ছে ঘি। পরে যেগুলো বিভিন্ন নামে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বাজারে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এগারো মাইল এলাকায় ওই অভিযান চালানোর পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানিয়েছেন, এক শ্রেণীর বাবুর্চি এসব ঘির ক্রেতা। শীত মৌসুমে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও রোজা সামনে রেখে এসব ঘি তৈরি করা হয়। অসাধু প্রকৃতির লোক পাম অয়েল, রং, সুজি, গাম, হলুদ ও লাল রঙের সারজাতীয় কিছু দ্রব্য ও এক ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করে এসব ঘি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে। ভোক্তারা অনেকটা না জেনেই এসব ঘি ব্যবহার করেন। জানা গেছে, এসব ঘি তৈরির পর বাঘাবাড়ি স্পেশাল খাঁটি গাওয়া ঘি, গোল্ডেন এসসি, গোল্ডেন পিএম, গোল্ডেন স্পেশাল, আরএস রাজেশ ঘোষ, সুপার বাঘা বাড়ি, থ্রি স্টার, বাঘাবাড়ি স্পেশাল, প্রিমিয়াম ও থ্রি স্টার গোল্ড জিএম নাম দিয়ে বাজারে বিক্রি করা হয়। রোজা সামনে রেখে এসব ভেজাল পণ্যের রমরমা ব্যবসা চলে। সম্প্রতি তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো এলাকার একটি হিমাগারে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ দুম্বা ও মহিষের মাংস, খেজুর ও কিশমিশ জব্দ করে র‌্যাব পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যপণ্য মজুত করার সত্যতা পাওয়া যায়। র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ২০১৭ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ কিশমিশ এখানে মজুত করে রাখা হয়। আর ২০০৬ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া থেকে শুরু করে ২০১৮ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর মজুত রাখা হয়েছিল। বিএসটিআই, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে বাজার থেকে সংগৃহীত খোলা ভোজ্যতেলে বিষাক্ত কেমিক্যালের অস্তিত্ব মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশ্রণের কারণে মানবদেহে নানা রোগ বাসা বাঁধছে। এসব কারণে ক্যান্সারের প্রকোপ বাড়ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ একেএম আমিরুল মোর্শেদ খসরু বলেন, সম্প্রতি শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে, যা আগে কখনও দেখা যেত না। ভেজাল খাদ্যের কারণে প্রথমে ডায়েরিয়া বা বমিভাব বেশি দেখা দিলে এ থেকে দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারে রূপ নিচ্ছে। ভেজাল খাদ্যের কারণে খাদ্যনালীতে ক্যান্সার, লিভার বা ব্লাড ক্যান্সার, মেয়েদের জরায়ুতে ক্যান্সারের প্রবণতা অনেক বাড়ছে। চিকিৎসায় প্রমাণ হয়েছে এগুলোর মূল কারণ হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। এর ফলে মানব স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব তা তাৎক্ষণিক বোঝা যায় না। কিন্তু যখন ধরা পড়ে তখন এ থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার উপায় থাকে না।
×