ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২

কাউন্সিলর একরাম নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের অডিও ক্লিপ ভাইরাল

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৩ জুন ২০১৮

কাউন্সিলর একরাম নিহত হওয়ার আগ মুহূর্তের অডিও ক্লিপ ভাইরাল

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ দেশজুড়ে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে টেকনাফের জনপ্রিয় পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার পর ঘটনা নিয়ে রহস্যের যে ডালপালা বিস্তার লাভ করেছে এবং এর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে তা সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে বেদনাহত করেছে। টেকনাফে মেরিন ড্রাইভে ২৬ মে একরামুল হক নিহত হন। তাকে তার বাসা থেকে বিশেষ সংস্থার দুই কর্মকর্তা ডেকে নেয়ার পর হত্যা করা হয়েছে বলে স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের পক্ষে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে। নিহত একরামুল হক ছিলেন টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি। তিনি টেকনাফ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের টানা তিন বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। স্থানীয় কায়ুকখালী গ্রামের মৃত আব্দুস সাত্তারের পুত্র কাউন্সিলর একরামের জনপ্রিয়তা ছিল নজরকাড়া। স্থানীয়দের দাবি, একরাম কখনও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত ছিলেন না। একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দাবি করেছেন ২৬ মে রাতে জরুরী কথা আছে বলে তার স্বামী একরামকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যান একটি বিশেষ সংস্থার পরিচয়ের এক কর্মকর্তা। একরাম সরল বিশ্বাসে তাদের ডাকে সাড়া দেন। ওইদিন রাত দেড়টায় মেরিন ড্রাইভ সড়ক থেকে পুলিশ কাউন্সিলর একরামের মৃতদেহ উদ্ধার করে। একরামের স্ত্রীর দেয়া ওই দিনের ঘটনা নিয়ে রেকর্ডকৃত অডিও ক্লিপটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানে সরকারের সফলতায় এই ঘটনাটি বড় ধরনের আচড় কেটেছে। শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঢাকায় বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, কাউন্সিলর একরাম নিহতের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শীঘ্রই তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে অপরাধের প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিজ বাস ভবনে সাংবাদিকদের কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য যদি আইন অমান্য করেন, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা প্রলুব্ধ হয়ে এ ধরনের ঘটনার সূত্রপাত করে থাকে-তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, একজন ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তে রয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেটের তদন্ত যদি কোন রকম ইঙ্গিত আমাদের দেয়, বা কোন নির্দেশনা থাকে তাহলে অবশ্যই সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। তিনি যদি নিশ্চিত করে দেন যে, এটা এ ধরনের ঘটনা তাহলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে। অপরদিকে র‌্যাব সদর দফতরও একই কথা বলেছে। র‌্যাব বলছে, টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের পরিবারের দেয়া অডিও টেপটি খতিয়ে দেখছে র‌্যাব সদর দফতর। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান ইতোমধ্যেই বিষয়টি জানান দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, যে অডিও রেকর্ডের কথা বলা হচ্ছে তা আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখছি। গত ২৬ মে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে একরাম নিহত হন বলে প্রচার রয়েছে। এছাড়া একরাম মাদক ব্যবসায়ী বলেও দাবি রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে নিহত পৌর কাউন্সিলরের স্ত্রী আয়েশা বেগম অভিযোগ করেন, বন্দুকযুদ্ধের নামে অন্যায়ভাবে তার স্বামীকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আমার স্বামীর হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার স্বামী হত্যার বিচার দাবি করছি। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের একটি অডিও রেকর্ড দিয়ে বলেন, এটি ২৬ মে রাতে একরামুল নিহত হওয়ার সময়ের। সংবাদ সম্মেলনে চারটি ক্লিপ মিলিয়ে ১৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের ওই অডিও রেকর্ডে কয়েকজনের কণ্ঠ, গুলির শব্দ আর চিৎকার সাংবাদিকদের শুনিয়ে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ওইদিন সম্মেলনে উপস্থিত একরামের বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, একরামের ফোন খোলা ছিল বলে এ প্রান্তে পুরো ঘটনা প্রবাহ রেকর্ড হয়েছে ফোনের অটো রেকর্ডারে। চারটি অডিও ক্লিপ সাংবাদিকদের শুনিয়ে আয়েশা বলেন, সেখানে শুরুতে মেয়ের সঙ্গে একরামের কথা, পরে তার নিজের কণ্ঠ রয়েছে। এরপর ওপ্রান্তে গুলির শব্দ, পুলিশের সাইরেন, চিৎকার-হাঁকডাক ও গালিগালাজ এবং এ প্রান্তে নারী ও শিশুদের আহাজারি মিলিয়ে রোমহর্ষক এক পরিস্থিতির চিত্র পাওয়া যায় ওই অডিও রেকর্ডে। টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুলকে র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বর্ণনা করা হয় ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক বিক্রেতা’ এবং ‘ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার’ হিসেবে। তবে তার পরিবার বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম তার দুই মেয়েক নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, জমি সংক্রান্ত বিষয়ের কথা বলে সেই রাতে তার স্বামীকে ডেকে নিয়ে যায় একটি বিশেষ সংস্থার এক কর্মকর্তা। পরে মেরিন ড্রাইভে নিয়ে একরামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একরামের স্ত্রী আয়েশা বলেন, একরাম ইয়াবার কারবারে জড়িত ছিলেন না। তার ব্যাংক ব্যালেন্স বা সম্পদের অস্বাভাবিক কিছু নেই। সেদিন রাত ১১টা ৩২ মিনিটের পর তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর সেটা যে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে, মোবাইলের ওই রেকর্ড যাচাই করলেই তা বোঝা যাবে। আয়েশার বিবরণ অনুযায়ী, একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার ক্রমাগত ফোন পেয়ে ২৬ মে রাত ৯টার দিকে একরাম বাড়ি থেকে বের হন। রাত ১১টার সময়ও বাড়ি ফিরে না এলে তার মেয়ে ১১টা ১৩ মিনিটে ফোন করে তার বাবাকে। অডিওতে শোনা যায়, মেয়ে জানতে চাইছে তিনি কোথায় আছেন। জবাবে বাবা বলেন, মেজর সাহেব ডেকেছিলেন, ওখান থেকে তিনি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছেন। টিএনও অফিস থেকে আসতে দেরি হবে কি না- মেয়ের এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে বাবা বলেন, দেরি হবে না। এরপর ফোন কেটে যায়। রাত ১১টা ১৪ মিনিটে একরামের মেয়ে আবারও ফোন করে জানতে চায় তিনি কোথায় আছেন। অপর প্রান্ত থেকে একরামের উত্তর আসে, আমি টিএনও অফিসে যাচ্ছি তো, আমি চলে আসব আম্মা। ফিরতে কতক্ষণ সময় লাগবে- মেয়ের এ জিজ্ঞাসায় অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, বেশিক্ষণ লাগবে না, আমি চলে আসব ইনশাল্লাহ, ঠিক আাছে? ঘুমাও। রাত ১১টা ৩২ মিনিটে আবারও মেয়ে ফোন করলে তার বাবা বলেন, হ্নীলায় যাচ্ছেন। কেন সেখানে যেতে হচ্ছে জানতে চাইলে উত্তর আসে, তিনি জরুরী কাজে যাচ্ছেন। মেয়ে তার কাছে আবারও জানতে চায়- কেন? ধরা গলায় জবাব আসে, যাচ্ছি আম্মু ঠিক আছে, যেতে হচ্ছে তাই। মেয়ে তখন জানতে চায়, আব্বু তুমি কেন কাঁদছো। এই অবস্থায় ফোন নেন আয়েশা। তিনি হ্যালো হ্যালো করতে করতেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে আবার ফোন করেন একরামের স্ত্রী। ফোন রিসিভ হওয়ার আগে তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন যেন একবার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়। ফোন রিসিভ হলে আয়েশা বলেন, “হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো কে? হ্যালো আমি কমিশনারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যালো ফোন রিসিভ করছে ওইটা কে? আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো, হ্যালো। এমন সময় ফোনের অপর পাশে কাউকে বলতে শোনা যায়, তুমি যেটা বলছ, জড়িত না? কেউ একজন (একরাম) বলেন, না। এরপর আগ্নেয়াস্ত্র ও দুটি গুলির শব্দ শোনা যায়। সেই সঙ্গে মরণাপন্ন কারও চিৎকার। ওই আওয়াজে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন একরামের স্ত্রী ও মেয়েরা। এদিকে একটানা তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর একরাম নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাটেবাজারে দোকানপাটে, রাস্তাঘাটে, ঘরে ঘরে সৃষ্টি হয়েছে বেদনাবিধুর পরিবেশ। একরামের জন্য অশ্রু ঝরছে না এমন ব্যক্তি টেকনাফে নেই বললেই চলে। এমনকি প্রশাসনের লোকজনও একরামের নম্র-ভদ্র স্বভাবের কথা ভুলতে পারছেন না। মৃত্যুর পরে জানা গেছে, নিহত একরাম খুবই অভাবী ছিলেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে সেই অভাব কাউকে বুঝতে দেননি। শুধু অভাবের চাপের মধ্যে রেখেছিলেন পরিবারকে। কক্সবাজার জেলা যুবলীগের সভাপতি খোরশেদ আলম জনকণ্ঠকে শনিবার বলেন, একরাম যখন টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন তখন আমি জেলার দায়িত্বে ছিলাম। একরামকে কক্সবাজারে আসার জন্য ডাকানো হলে উত্তর পাওয়া যেত, লিডার টাকা নেই, মাইক্রো ভাড়া সঙ্গে কয়েকজন কর্মীদের খরচ মেটাবো কি করে? আরও বহু কথা। তার সততা এবং মাদকবিরোধী তৎপরতার ফিরিস্তি বলে শেষ করা যাবে না বলে খোরশেদ আলম জানান।
×