ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

গণমানুষের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য’র প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা

শরিফুল রোমান,মুকসুদপুর,গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৬:৫০, ১৩ মে ২০২৫; আপডেট: ১৬:৫২, ১৩ মে ২০২৫

গণমানুষের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য’র প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা

ছবি:সংগৃহীত

সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম কালীঘাট, কলকাতা, ব্রিটিশ ভারতে। তিনি ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক নিবাস ছিল গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে। পিতা নিবারন ভট্টাচার্য, মা সুনীতি দেবী।  

তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়।

সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। 

জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক মানুষ ছিলেন তার জেঠতুতো দিদি রাণী। সে সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মণীন্দ্রলাল বসুর ‘সুকান্ত’ গল্পটি পড়ে রাণীদিই তার নাম রেখেছিলেন ‘সুকান্ত’। হঠাৎ করে একদিন প্রিয় মানুষ টি মারা গেলে প্রচন্ড ধাক্কা খান, এর কিছুদিন পর তার মাও চিরবিদায় নেন। একের পর এক মৃত্যুশোক যেন তাঁকে করে তুলেছিলো নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর…কবিতাই তখন ছিল তার একাকীত্বের সঙ্গী। 

শৈশব কাটিয়েছেন বাগবাজারের তাদের নিবেদিতা লেনের বাড়িটিতে এবং সেখানকারই কমলা বিদ্যামন্দিরে তাকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করা হয়। কমলা বিদ্যামন্দিরেই সুকান্তের সাহিত্যেও হাতেখড়ি হয়। বলা হয়ে থাকে, ‘উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়’…সুকান্তের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শৈশবেই তার সাহিত্যানুরাগ স্পষ্ট হতে থাকে, তার প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় বিদ্যালয়েরই একটি পত্রিকা- ‘সঞ্চয়’ এ। এরপর ‘বিবেকানন্দ জীবনী’-আরো একটি রচনা 'শিখা' পত্রিকায় ছাপা হয়। শিখা পত্রিকায় সেসময় প্রায়ই সুকান্তের লেখা ছাপা হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। কৈশোর থেকেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে। 

১৯৪১ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য কোলকাতা রেডিও আয়জিত "গল্পদাদুর আসর" নামক এক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। সেখানে তিনি প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তখন সেই আসরেই তিনি নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধাও জানান।

সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের বর্ণনা দিয়েছেন এমন করে-"গোর্কীর মতো, তার চেহারাই যেন চিরাচরিতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কানে একটু কম শোনে, কথা বেশি বলেনা, দেখামাত্র প্রেমে পড়ার মতো কিছু নয়, কিন্তু হাসিটি মধুর, ঠোঁট দু’টি সরল"। আরো বলেছেন, "যে চিলকে সে ব্যঙ্গ করেছিলো, সে জানতো না সে নিজেই সেই চিল; লোভী নয়, দস্যু নয়, গর্বিত নিঃসঙ্গ আকাশচারী, স্খলিত হয়ে পড়লো ফুটপাতের ভিড়ে, আর উড়তে পারলো না, অথবা সময় পেলো না। কবি হবার জন্যই জন্মেছিলো সুকান্ত, অথচ কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো"।

১৯৪৭ সালের ১৩ মে, অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

আলীম

×