ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

জসীম উদ্দীনের গান ও কবিতা  লোকজ ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ

আমির হোসেন

প্রকাশিত: ০১:৩৯, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩

জসীম উদ্দীনের গান ও কবিতা  লোকজ ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ

.

রবীন্দ্র-নজরুলের মতো জসীম উদ্দীনও বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য স্বতন্ত্র ধারার কবি। তাঁর কবিতার কলা-কৌশল গঠন শৈলিতে আমরা গ্রাম্য আবহকে মূর্ত হতে দেখি। কিন্তু তাই বলে তিনি পরিপূর্ণভাবে গ্রাম্য কবি নন। কারণ কাব্য রচনায় তিনি উপমা উৎপেক্ষা রূপক প্রয়োগে যথেষ্ট অনুশীলনের পরিচয় দিয়েছেন এবং কাহিনী নির্মাণে উপন্যাসের গঠন-প্রকৃতি অবলম্বন করেছেন। জসীম উদ্দীন কল্লোল যুগের একজন প্রতিনিধিত্বশীল কবি হয়েও এবং আজীবন নগরে বাস করেও তাঁর কবিতা লোক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। এবং এটি তাঁর মনন, স্বভাব দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই সম্ভব হয়েছে। মূলত জসীম উদ্দীনের কবিস্বভাব দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সর্বাত্মক আধুনিকতার যুগেও তিনি একটি নির্দিষ্ট কাব্যভুবন নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এবং কবি প্রতিভার গুণে তিনি বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার এই যে, জসীম উদ্দীন আধুনিক যুগের আধুনিক কবি হওয়া সত্ত্বেও পল্লী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। অথচ কল্লোল যুগের প্রায় সব কবিই নগর-চেতনায় প্রাণিত উদ্বুদ্ধ হন এবং কবিতার নতুন বিষয়বস্তুর জন্য বিশ্বসাহিত্যের দ্বারস্থ হন, কেননা পল্লী প্রকৃতি লোক-ঐতিহ্যের মোহন রূপ আধুনিক কবিদের চেতনায় মননে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। ফলে নগরই হয়ে উঠে আধুনিক কবিতার উপাদান উপকরণের ক্ষেত্র। বলা ভালো, বিশ্ব সাহিত্যেও চেতনা সামান্য ছিল না। চার্লস ল্যাম (১৭৭৫-১৮১৪), চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭৬), ভিক্টর হিউগো (১৮০২-১৮৫৫), অনারিদে বালজাক (১৭৯৯-১৮৫০), আনাতোল ফ্রাঁস (১৮৪৪-১৯২৪), শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭) প্রমুখের লেখায় নগর-চেতনার প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অথচ জসীম উদ্দীন পল্লী প্রকৃতি, পল্লীর বিষয় বস্তু জীবনের প্রাচুর্যকে মনের মাধুরী মিশিয়ে উপস্থাপন করেছেন। তাইতো তিনি পল্লী কবি।

জসীম উদ্দীন কাব্যক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করেনকবরকবিতাটি নিয়ে। এর পর তাঁর প্রতিভার বিশিষ্টতায় সহজ এবং সতেজ উপমনা ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাম-প্রকৃতির মধ্যে যে অনায়াস সহজতা বিদ্যমান তার পরিচয় তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তাঁর রাখালী, বালুচর, ধানক্ষেত, হাসু, রঙিলা নায়ের মাঝি, এক পয়সার বাঁশি, নকশিকাথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট, মাটির কান্না ইত্যাদি গ্রন্থে। জসীম উদ্দীনের সুবিখ্যাত কাব্যগ্রন্থরাখালী (১৯২৭) প্রকাশের মাধ্যমেই তাঁর মূল্যায়ন সমালোচকদের পক্ষে সহজ হয়ে পড়ে।কবরকবিতাটিও রাখালী গ্রন্থভুক্ত। এই সুপ্রসিদ্ধ কবিতাটি কল্লোল পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে জসীম উদ্দীন কেড়ে নিয়েছিলেন তাৎক্ষণিক খ্যাতি-নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার মতো, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের মতো।কবরকবিতা খ্যাতি কুড়িয়েছিল বাইরনের (১৭৮৮-১৮২৪) ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’, শেলীর (১৭৯২-১৮২২) ‘প্রোমিথিয়ুস আনবাউন্ড’, কীটসের (১৭৯৫-১৮২২১) ‘ওড টু নাইটিঙ্গলএবংওড্ অন গ্রিসিয়ান আর্ন’, কোলরিজের (১৭৭২-১৮৩৪) অলৌকিক রোমান্টিকতা মূলক কবিতাদ্য রাইম অব্ অ্যানশিয়েন্ট ম্যারিনার’, ম্যাথু আর্নল্ডের (১৮১২-১৮৮৮) ‘দি ফরসেকেন মারমেড’, লুইস ক্যারলের (১৮৩২-১৮৯৮) ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’, রবার্ট ফ্রস্টের (১৮৭৪-১৯৬৩) ‘নর্থ অব বোস্টনপ্রভৃতি কবিতা গ্রন্থের মতো।

জসীম উদ্দীন আধুনিক কবিতার রীতি প্রকৃতি অনুসারে প্রেমের পূর্বরাগ, মিলন, এবং বিরহকে যুক্তিসহকারে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি যে সমস্ত উপমা ব্যবহার করেছেন সেগুলোর উপাদান গ্রাম থেকে সংগৃহীত। কিন্তু উপমার ব্যাখ্যাসূত্র প্রধানত নাগরিক। উপমান এবং উপমেয়ের মধ্যে একটি যুক্তিসহ নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাসূত্র আছে যা বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিক কবিতার লক্ষণ। একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে নবীন কাব্যজগতের নামজাদা কবিরা ইউরোপের সাহিত্য আন্দোলনে প্রভাবিত নন শুধু, মুগ্ধ  অনুসরণকারী। রবীন্দ্র-নজরুলের রোমান্টিকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে এজরা পাউন্ড (১৮৮৫-১৯৭২), টিএস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫), জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) প্রমুখ কবিগণ প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে অমিয় চক্রবর্তী সবার মননে গেঁথে বসেছে। কিন্তু এরই মাঝে জসমি উদ্দীন সবাইকে উপেক্ষা করে তাঁর নিজ দেশ, মানুষ, প্রকৃতি পল্লীর বর্ণনায় ছিলেন অবিচল। আর শব্দ চয়নে খুব সাধারণ হয়েও অসাধারণ প্রযোগ সৃষ্টি করে গেছেন অনন্য জীবনমুখী, পল্লী-নিবিষ্ট কাব্যমালা। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ অতীতাচারী। তিনি পিপাসিত মনে মুক্ত বাংলার প্রকৃতি আর সহজ সরল মানুষ তার সঙ্গে পল্লী জীবনের অবহেলিত, উপেক্ষিত, দরিদ্র করুণ জীবনের সংবেদনশীলতা, আবেগ, অনুভূতি, অনুভব লিপিবদ্ধ করে গেছেন সত্য নিষ্ঠভাবে। তিনি লোকজ লৌকিক প্রাত্যাহিক ঘটনা যেগুলো গ্রাম বাংলার শেকড়কে চেনায় তা আমাদের সামনে তুলে এনে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর পুরনো কিন্তু চিরায়ত জীবনযাপন প্রণালি সাহিত্যে অমর করে গেছেন।

গ্রাম এবং গ্রামের জনগোষ্ঠীর প্রতি অকৃত্রিম দরদী ছিলেন বলেই তাঁর কাব্য নাগরিক কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত পল্লীর সহজ-সরল জীবনের অমর রচনা হিসেবে মর্যাদা পায়।

তাঁর সুজন বাদিয়ার ঘাট, নকশিকাঁথার মাঠ ইত্যাদি গাঁথাকাব্যে পল্লীবালার অনুরাগের সঙ্গে পল্লীবালকের হৃদয় জুড়ে কবি যে গ্রাম বাংলার অসাধারণ লোকায়ত চিত্র অঙ্কন করেছেন তাতে নিশ্চয় আমরা বিশ্বজনীনতার ছাপ লক্ষ্য করি। তাই জসীম উদ্দীন শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য কবি নন তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রাহকও। যেটি বাংলা সাহিত্যের লোকশিল্প বা লোককথা বা ফোকলোরকে নতুন মাত্রা দিয়েছে; তিনি দীনেশ চন্দ্র সেন এক সঙ্গে ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করেন। লোকজ কাহিনী লৌকিক জীবনে শিল্পবোধের প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর এক দাদার কাছ থেকে। তিনি ছিলেন তাঁর বাবার এক চাচা। যার নাম ছিল দানু মিয়া। যিনি অন্ধ ছিলেন। এবং জীবনভর কেচ্ছা-কাহিনী, লোকজ ছড়া, গান, পালা গেয়ে বেড়াতেন। সেই অন্ধ দানু মিয়ার প্রভাব বহুলাংশে কবির রচনায় আমরা দেখতে পাই। জসীম উদ্দীন নিজেই তাঁরজীবন কাহিনীনামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থটির ৪৫ পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন-

আমার কবি জীবনের প্রথম উন্মেষ হইয়াছিল এই দাদার গল্প, গান কাহিনীর  ভেতর দিয়া। সেই ছোটবেলায়ই মাঝে মাঝে আমাকে গানে পাইত। নিজে মনোক্তি করিয়া ইনাইয়া বিনাইয়া গান গাহিয়া যাইতাম। দাদা একদিন একজনকে বলিতেছিলেন, ‘পাগলা গানের মধ্যে কি যে বলে কেউ শোনে না। আমি কিন্তু শুনি মনোযোগ দিয়া ওর গান।কি অন্তর্দৃষ্টির বলেই না আমার রচক-জীবনের প্রথম আকুলি-বিকুলি তিনি ধরিতে পারিয়াছিলেন।

অন্ধ দানু মিয়ার ভবিষ্যৎ বাণীর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই জসিম উদ্দীনের দেহতত্ত্বের গান, ভাওয়া গান লোক সংগীতের মাঝে। একেবারে নিম্নশ্রেণির মানুষসহ সাধারণ খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্র অত্যন্ত সরল, সাবলীল প্রাঞ্জল ভাষায় জসীম উদ্দীন উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় বেদে-বেদেনীদের সেই গান যা মানুষের মুখে মুখে আজও শোনা যায়-

বাবু সেলাম বারে বার,

আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু

বাড়ি পদ্মাপাড়।

অভিজাত শ্রেণির কাছেঅছ্যুৎঅভিধায় পরিচিত এসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে জসীম উদ্দীনের মেলামেশা দীর্ঘদিনের। তাই তিনি এদের আচার-সংস্কৃতি-জীবনধারা সবকিছু আয়ত্তে নিতে পেরেছিলেন। পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি তাঁর রচিত পল্লীগীতিগুলোতে ভাউলতত্ত্বের ভেদ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন-

 

নাও বাইও বাইও ভাই মাঝিয়ারে

ছল ছল কল কল, সুষায় নদীর জল

বাউলতত্ত্বের গান ছাড়াও জসীম উদ্দীন বেশ কিছু পল্লীগীতি রচনা করেছেন। এসব গানে বাঙালির জীবনের চিরায়িত প্রেম উপজীব্য হয়েছে। যেমন-

সোনার বরণী কন্যা সাজে নানা রঙে,

কালো মেঘ যেন সাজিলরে।

সিনান করিতে কন্যা হেলে দুলে যায়,

নাদীর ঘাটেতে এসে ইতি উতি চায়।

নদীর সঙ্গে বাংলার মানুষের যোগসূত্রতা অত্যন্ত নিবিড় সুপ্রাচীন। ভাটিয়ালী গান এদেশের নদী অববাহিকার মানুষের প্রাণের খোরাক। নদী, নৌকা, মাঝি তাদের জীবনের সুখ, দুঃখ আনন্দ বেদনার কথাগুলো অত্যন্ত সহজ শব্দে গানের সুরে জসীম উদ্দীন সাজিয়ে তুলেছেন। যেমনÑ উজান গাঙের নাইয়া/ভাটি গাঙের নাইয়া/তুমি কইবার নি পাররে নদী/গেছে কতদূর?

লোকসংগীতের বাইরেও জসীম উদ্দীনের আধুনিক বিখ্যাত গান রয়েছে। যেমনÑ আমার সোনার ময়না পাখি/নিশিতে যাইও ফুলবনে, ভোমরা/আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে, অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে/প্রাণো সখী রে শুন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে ইত্যাদি।

এছাড়া লোকসংগীতের বিশাল ভান্ডা সৃষ্টি সংগ্রহে যে সকল মহাত্মা নিরলস পরিশ্রম করেছেন তাদের মধ্যে জসীম উদ্দীম অন্যতম। তিনি পল্লী এলাকার মানুষের মুখে মুখে পঠিত গীত-পুঁথি-ছড়া ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন। এসব সংগ্রহকালে তিনি গ্রামীণ জনপদের আনন্দ বেদনার কাব্যগাঁথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন, মানুষকে ভালোবেসে একজন খাঁটি মানবপ্রেমী হয়ে ওঠেন। জসীম উদ্দীন পালাগান, গাজীর গান, লোকগীতি ইত্যাদির আসরে যেতেন, উপভোগ করতেন।

পালাগান, গাজীর গান, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শীদি, মারফতি, ঘাটু গান, কৃষ্ণলীলা, গম্ভীরা, কবি গান, সাপুড়ে গান ইত্যাদি লোকসংগীত সংগ্রহ, সংরক্ষণ   এগুলোর উপর বিস্তর গবেষণাও করেন তিনি। জসীম উদ্দীন তাঁর দীর্ঘ জীবনে প্রায় দশ হাজারেরও অধিক লোক গান সংগ্রহ করেছিলেন। যা বাংলা লোকসংগীতের এক অনন্য ভান্ডার।

×