ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

শীত এবং পিঠা-পুলির উৎসব

প্রদীপ সাহা

প্রকাশিত: ২১:২৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

শীত এবং পিঠা-পুলির উৎসব

ভারতীয় উপমহাদেশে পিঠা খাওয়ার প্রচলন অনেক প্রাচীন

ভারতীয় উপমহাদেশে পিঠা খাওয়ার প্রচলন অনেক প্রাচীন। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধান উঠার পর সেগুলো গোলাবন্দি করতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। এই কর্মব্যস্ত সময়ে গ্রামীণ মানুষের ‘শখ’ করার সময়টুকু থাকে না। নবান্নের পর জাঁকিয়ে শীত পড়লে পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। তারপর বসন্তের আগমন পর্যন্ত চলে হরেকরকমের পিঠা খাওয়ার ধুম। মূলত মাঘ-ফাল্গুন এই দুই মাসই জমিয়ে পিঠা খাওয়া হয়। এরপর আর পিঠার স্বাদ ঠিকমতো পাওয়া যায় না।

বাংলাভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকায় কাজল রেখা গল্প কথনের সূত্র ধরে আনুমানিক ৫০০ বছর সময়কালে বাঙালি খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু প্রাচীন বই-পুস্তকে পিঠার কথা উল্লেখ আছে, কাজেই ধরে নেওয়া যায়, পিঠা খাওয়ার প্রচলন বাঙালি সমাজে অনেক প্রাচীন। বিশাল উপমহাদেশে বসবাস করা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পিঠা যে জনপ্রিয় খাবার, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসেবে পিঠার জনপ্রিয়তাই সম্ভবত বেশি ছিল।  
শুরুতে মিষ্টি খাবার হিসেবেই পিঠা খাওয়া হতো। এখনো বাংলাদেশের বেশিরভাগ পিঠা মিষ্টি জাতীয় এবং গুড়সহ খাওয়া হয়। চিতই পিঠা খাওয়ার আদি পদ্ধতি হলো ঝোলাগুড় দিয়ে খাওয়া। তবে কখনো কখনো ঝাল পিঠা খাওয়ারও প্রচলন রয়েছে। যেমনÑ চিতই পিঠা সরষে বাটা, ধনে পাতা বাটা কিংবা মরিচের ভর্তা বা শুঁটকির ঝাল ভর্তা দিয়েও খাওয়া হয়। আবার ছিট পিঠার আটায় মরিচ বাটা মিশিয়ে ঝাল করে ভাজা হয়। হাঁসের মাংস দিয়েও ছিট পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বেশিরভাগ পিঠা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাওয়া হলেও কিছু কিছু পিঠা আছে আঞ্চলিক, যেগুলো নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে তেমন একটা খাওয়া হয় না। যেমন সিলেটের চুঙ্গি পিঠা, বিক্রমপুরের বিবিখানা পিঠা ইত্যাদি।

বাঙালির লোকজ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। পিঠা-পায়েস সাধারণত শীতকালের রসনাজাতীয় খাবার হিসেবে অত্যন্ত পরিচিত এবং মুখরোচক খাদ্য হিসেবে বাঙালি সমাজে বেশ আদরণীয়। আত্মীয়-স্বজন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পিঠা-পুলির উৎসব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম শীতকালেই বেশি পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধুরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত সময় কাটান পিঠা তৈরিতে। অতিথি বিশেষ করে জামাইদের এ সময় দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হয়। এ সময় খেজুরের রস থেকে গুড়, পায়েস এবং নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়।

খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠে। শীতকালের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা। এছাড়াও আছে চিতই পিঠা, দুধচিতই, ছিট পিঠা, দুধকুলি, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি, পাটিসাপটা, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, ঝাল পিঠা ইত্যাদি। বাংলাদেশে শতাধিক ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে। কালের গভীরে কিছু হারিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শীতকালে শুধু গ্রাম-বাংলায়ই নয়, শহর এলাকায়ও শীতের পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। ইদানীং শহরেও পাওয়া যায় শীতের পিঠার সুবাস। হিন্দু সমাজে যেমন নতুন ধানের নতুন চালে জমে ওঠে পৌষপার্বণ, মুসলমান সমাজেও তেমনি ফুটে ওঠে পিঠা-পায়েসের আনন্দ। 
শীত এলে শহর এলাকার বিভিন্ন ফুটপাথে, জনবহুল এলাকায়, বিভিন্ন টার্মিনালে পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। ভাপা পিঠার পাশাপাশি চিতই পিঠা, কুলি পিঠা, পাটিসাপটা, মালপোয়া ইত্যাদিও বিক্রি হতে দেখা যায় পুরো শীতকালজুড়েই। যদিও খোলামেলা স্থানে এসব পিঠা তৈরি ও বিক্রি সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর, তারপরও এ ব্যবসা বিশেষ করে ভাপা পিঠা বিক্রি শীতকালে বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথিক গরম গরম ভাপা পিঠার মোহনীয় গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে কিনে নিয়ে যান পরিবারের জন্য, আদরের সন্তানদের জন্য।

শহরের অনেক দোকানে এখন শীতের পিঠা কিনতে পাওয়া যায়। ব্যস্ত জীবনে পিঠা তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলেও শহরের বেশ কিছু জায়গায় গড়ে উঠেছে পিঠাঘর। মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত শীতের পিঠা উৎসব সাড়া ফেলে দেয় শহুরে জীবনে। তাই শহরের বিলাসীতায় থাকা অনেকেই এখন সহজে পেয়ে যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা। তবে গ্রামাঞ্চলে শীতের পিঠা তৈরিকে যেমন উৎসব হিসেবে গণ্য করা হয়, সে তুলনায় শহরে খুব কমই চোখে পড়ে পিঠা-পুলির ব্যবহার।  এক সময় সোনার বাংলায় যেমন শত শত নামের ধান ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কত কী বিচিত্র নামের পিঠা! পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্য।

পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনো অসংখ্য গান-কবিতা ও ছড়া প্রচলিত আছে। পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ পিঠা-পুলি আমাদের লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই বহির্প্রকাশ। আমাদের হাজারও সমস্যা সত্ত্বেও গ্রাম-বাংলায় এসব পিঠা-পার্বণের আনন্দ-উদ্দীপনা এখনো মুছে যায়নি। পিঠা-পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ ধরে টিকে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে।

×