ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০১ মে ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিলরুবা আহমেদ

গল্প ॥ মেরী মি মেঘা

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৩১ মার্চ ২০১৭

গল্প ॥ মেরী মি মেঘা

:মেঘনা নদীর পাড়ে যদি ছোট একটা বাড়ি করে দাও তবে তোমাকে বিয়ে করবো। রাতুল অবাক হয়ে দ্রুত মনে করার চেষ্টা করে মানচিত্রের কোথায় মেঘনা নদীঁঁঁঁঁটা রয়েছে। কোন্দিক থেকে কোথায় ধেয়ে গেছে সেটা। প্রথমেই মনে পড়লো পদ্মা। উপর থেকে নিচে দক্ষিণে নেমেছে বাংলাদেশের ম্যাপে। এর উপর ব্রিজ নিয়েও প্রচুর কথা শুনছে ইদানীং। আমেরিকায় আছে বলে যে শুনবে না তা তো নয়। চট করে খুব দ্রুত গুগলে গিয়ে দেখে নিল মেঘনা নদীটা কোথায়-কিভাবে বয়ে গেছে। কিন্তু ওখানে কেন চাইছে! এর দেশ তো সুরমা নদীর আশেপাশে কোথাও, সিলেটে। বুঝলো না যদিও, তারপরও সাথে সাথেই বললো, : ঠিক আছে ,নো প্রবলেম, হয়ে যাবে। : আচ্ছা বানাও, তারপরে বিয়ে। : হুম, আচ্ছা। কিন্তু আমার তো অত টাকা নেই, এখনও। : টাকা বানাও তারপরে। : বুড়া হয়ে যাব তো ততদিনে। : বুড়াকে বিয়ে করবো। : তুমিও বুড়ি হয়ে যাবে এবং আমি বুড়িকে বিয়ে করবো না। এ কথায় মেঘা হা হা করে হেসে উঠেছে,উছল হাসি। তারপরেই বলছে, : জানতে চাইলে না কেন , হোয়াই মেঘনা রিভার? আর তখুনি রাতুল হঠাৎ করে ধরে ফেললো যেন কারণটা। বললো, : মেঘা তো মেঘনা নদীর কূলই পছন্দ করবে। তাই না ! মেঘা এবার আবারও হো হো করে হেসে উঠলো। রাতুল জানে মেঘা হেসে উঠে সব সময়ই ঘর ফাটায়। প্রথম দেখাটায় ঐ হাসিই চোখ জুড়াতে টেনেছিল চোখ জোড়াকে। ফাস্ট ফুডের দোকানে হা হা করে হেসে উঠার শব্দটা শুনেই ফিরে চেয়ে প্রথম দেখেছিল মেঘাকে। ওয়েস্টার্ন হাইফাই ড্রেস পরা একদল ছেলেমেয়ের সাথে বারগারে কামড় দিচ্ছে ঘন সবুজ রংয়ের শাড়ি পরা এক রূপবতী। মেঘাকে তার রূপবতীই মনে হয়েছিল। কিন্তু জানে না কেন রূপবতী ভেবেছিল। আসলে তো হালকা কালো রংয়ের সাদামাটা একটা চেহারার মেয়ে এই মেয়েটা। কিন্তু কেন যেন প্রতিদিনই তার মনে হয় এতো আরো রূপসী হয়ে এসেছে আজ। দিনে দিনে যেন রূপ বাড়ছে তো বাড়ছেই। নাকি তার ভালবাসা আরও বেগবান হচ্ছে। বললো, : এই দেশেই বানাই। টেক্সাসের কোন একটা নদীর তীরে। : আমি এখানকার একটা কোন নদীর নামও জানি না। : চল ম্যাপ দেখি। : এত কষ্ট করে বার করে জানতে হবে না। যে জানা অটো জানা সেটাই রিয়েল জানা। : অটো জানা কি? : এই যেমন মা। তোমার আপন মা কে, সেটা তুমি যেমন জন্ম থেকেই জেনে যাও অটোমেটিক সেরকম কিছু। কেউ কি তোমাকে শিখিয়েছে বাংলাদেশ তোমার দেশ। এদেশে তো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে এবার তুমি এদেশের নাগরিক,পাবলিক। ফাংশন করে শপথ নিয়ে ক্লেপ দিয়ে ইন্টারভিউতে পাস করা নাগরিক। বলেই চোখ নাচায় মেঘা। : বাহ্ যাচাই করে পাকাপোক্ত করে নিলে কি হয়। এমনই তো করা উচিত। : উড়ে এলে তাই করতে হয়। জন্মালে ঐ মাটিতে তা আর করার দরকার পড়ে না। রাতুল খেয়াল করেছে মেঘার সবকিছুর ব্যাপারেই নিজস্ব এক ধরনের ব্যাখ্যা থাকে। এটাও তার ভাল লাগে। এ থেকে যেন সে বুঝতে পারে মেঘা মেঘের মতন হালকা নয়। গভীর সে বৃষ্টির মতন। ঝরলে বন্যা বইয়ে দিতে পারে। বলেওছিল ঐ মেয়েকে একদিন। মেয়ে শুনেই হেসে বললো, : মেঘ থেকেই তো বৃষ্টি। গোড়া কেটে আগায় পানি দিচ্ছো যে বড়। হেসেই চেয়েছিল মেঘকুমারী। ঠিকই তো বলছে মেঘা। সব কথার তাৎক্ষণিক কোন উত্তর থাকে ওর ঠোঁটে। বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। মেঘাকে ঘুরিয়ে কি বলা যায় বুঝতে না পেরে চেয়ে থেকে ছিল। আর ভাবছিল কি বলা যায়। ভেবে বার করবার আগেই হেসে মেঘা বললো, ওরে আমার বুদ্ধুরাম, বললেই তো পার তোমার দেখার চোখ অসাধারণ। সব কিছু কত দারুণভাবে দেখ। তা বললেই তো আমি পটে লাড্ডু হয়ে যাই। তা না বলে হাবার মতন চেয়ে আছ, জীবনেও পারবে না মেয়ে পটাতে। রাতুল হাসে, হাসতে থাকে। মনে পড়ে যখন পড়তো ক্লাস সেভেনে তখন দেশ ছেড়ে চলে এসেছিল, সেই কবে। বহু বছর এদেশে বসবাস করছে। ভার্জিনিয়ার যে পরিবারটি তাকে দত্তক নিয়েছিল তাদের সাথেও আজকাল খুবই কম দেখা হয়। মাঝে মাঝে থ্যাংকস গিভিং বা খ্রীষ্টমাস-এ যায়। দেশেও কেও আছে কিনা আর জানে না। তবে মনে আছে অনেক কিছু। ঈদ-রোজা সব মনে আছে, মিস করে। রাসূলপুর গ্রাম থেকে সোজা ভার্জিনিয়ার ফেয়ার ফক্স। চাকুরী নিয়ে এখন ডালাস টেক্সাসে। মেঘা এসেছে পড়তে। বলে চলে যাবে। দেশে ফিরে যাবে। কতবার বলেছে মেঘাকে বিয়ে করে ফেল আমাকে, সিটিজেনশিপ হয়ে যাবে। মেঘা হাসে। কখনো বাড়ি চায় কখনো চাঁদ চায়। কখনো বলে একটা নদী কিনে দাও। নদী কিনে দিতেও রাজি হয়েছে । তখন আবার চোখ কপালে তুলে অবাক হয়ে বলেছে, নদী কিভাবে কিনবে? সে হেসে বলেছে, আমাদের মেয়ের নাম রাখবো নদী। মেঘা হো হো করে হেসেছে তখনও। একদিন জানতেও চেয়েছে, তোমার বিদেশী বাবা-মা মেনে নেবে দেশী বৌ। : ওরা এটা নিয়ে ভাবে না, মাতে না। ওদের ছেলেই তো দেশী। ওরা মানবতাবাদী। ছেলেমেয়ে ছিল না। আমাকে নিয়ে এসেছিল। কি একটা এন জিও-তে সেই ফরিদপুরে গিয়েছিল। ঘুরে বেড়াতাম মাঠে। রাখালের ছেলে, ক্লাসে ভাল ছিলাম। মামার বাড়ির অন্ন ধ্বংস করতাম। হেড স্যার কি যে কি বললেন কে জানে। এনারা আমাকে নিয়ে এলেন। একদম অন্য জীবন হয়ে গেল। ভাল না খারাপ জানি না। : আমি জানি। অনেক ভাল। অনেক ভাল জীবন হয়েছে তোমার। দেশে থাকলে ট্রাফিক জ্যামেই বসে বসে বুড়ো হয়ে যেতে। এই জীবনে আর বেশিদূর এগুতে পারতে না। পেছন থেকে চেপে ধরতো বহুজন। বলে আবারও ঘর ফাটিয়ে হেসে ছিল মেঘা। ও হাসলে মনে হয় যেন প্রচণ্ড গরমে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। আজও বললো, : শোন আবারও বলছি। আজ শেষ বারের মতন বলছি, আমায় বিয়ে করে নাও। মেরী মি। তোমাকে হারাতে চাই না আমি। : পেয়েছো কি যে হারাবে? শোন তুমি এদেশের সাদা কোন মেয়েকে বিয়ে কর। তোমার বাবা-মা খুশী হবেন। : কতবার বলছি ওনারা এটা নিয়ে ভাবছেন না মোটেও। মেয়ে বাছাইয়ে আমার সবটুকু স্বাধীনতা রয়েছে। ওনারা আমার নাম বদলায়নি। ধর্মও না। বদলেছে শুধু দেশ। আমি বাংলায় কথা বলতে চাই। আমি আলু ভর্তা দিয়ে শৈশবের মতন ভাত-মাছ খেতে চাই। আমার অন্য মেয়েটার মানে ছোট মেয়েটার নাম রাখবো বাংলা। নদী আর বাংলা। তুমি শুধু বল হ্যাঁ। এবার আর হাসছে না মেঘা। মেয়েদের কথায় মায়ের মন গলেছে বোধ হয়। চুপচাপ দেখছে তাকে। বেশ ভালভাবেই অবলোকন করছে। যেন এতদিন দেখেনি। আমজনতার সাথে যেন এতদিন ঘুরে বেড়িয়েছে চোখ বন্ধ করে। বাহ! বেশ।বেশ সিরিয়াস মুখ করার চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে। ঐ রকম গম্ভীরভাবেই বললো, : তুমি কি জান বাংলাদেশের বাবা-মায়েরা এখনও কত কনজারভেটিভ। এদেশীয় পিতামাতার কাছে ভিন্ন সংস্কৃতির ভাবধারার বড় হয়ে উঠা একজনের কাছে তারা মেয়ে দিতে রাজি হবেন তো? রাতুল বুঝতে পারছে দত্তক নেওয়া ছেলে এই কথাটা মেঘা এড়িয়ে গেছে। : শিকড়বিহীন লাগামহীন ছেলে পিতামাতা নাও পছন্দ করতে পারেন কিন্তু ভালবাসায় তো সব সম্ভব। : বলেছি কখনো তোমাকে যে আমি ভালবাসি তোমাকে? : তিন বছর ধরে চিনি। সব বোঝাই কি মিথ্যে? :জীবনটা ধরছি মিনিমাম আরো ৩০ বছরের লম্বা হবে। অত লম্বা সময় পাশাপাশি থাকা যাবে কিনা ভাবা দরকার। : এত ভেবে কী জীবন চলে? : চলে। চলতে হয়। আমার বয়স ৩০। আমি চাইলেই ২০ বছরের মেয়ের মতন ভাবতে পারি না। : আমার ২৫। তাই হয়তো আমি ছেলে হয়েও ২০ বছরের মেয়ের মতন ভাবছি। : এটাও একটা সমস্যা। ৫ বছরের ছোট। : ঐশ্বরীয়া ৩ বছরের ছোট ছেলেকে বিয়ে করেছে। এটা শুনে হা হা করে হাসছে ঐ রূপবতী। বলবে নাকি তাকে, তুমি কি অভিষেক বচ্চন নাকি? সেও তাহলে বলে বসবে তুমি রূপবতী না তুমি কালোবতী। কলাবতী। ধুর ঐ রূপসীকে সেরকম কিছুই বলা যাবে না। প্রাণ দেবে না বলতে। জান গেলেও বলতে পারবে না। বললো, : আমার মনের বয়স অনেক বেশি। বহু ঘুরে বহু ঘাটে ধাক্কা খেয়ে এতদূর আসা। বাবা-মায়ের পর চাচার বাড়ি, মামার বাড়ি হয়ে এতদূর এসে পৌঁছানো। বোঝ না কেন এর মধ্যেই আমি মনে মনে ৫০ এর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। : আর এর মাঝে তোমার জীবনে দশটা মেয়ে এসে চলেও গেছে। আমিও চলে যাব। তুমিও চালিয়ে যেতে পারবে। : ওরা শুধু বন্ধু ছিল। : আমরাও তাই থাকি। : কেন না কর এত। ওরা সাদা ছিল সব। আমার মতন না। তোমার মতন না। : আমি কালো। : না ,বাদামি, মানে সোনালি। হেসে উঠলো রূপসী আবারও। বললো, : শোন আমি আগামী মাসেই চলে যাচ্ছি দেশে। জীবনে চলার পথে অনেককেই ভাল লাগবে, তবে লাগলেই তাকে জীবন সাথী করা প্রয়োজনীয় নয়। খুব বেছে একজনকে আমি খুঁজে নেব। ভাল লাগলেই ভাল বাসবো না। : যেন তোমার ইচ্ছে মতন তুমি ভালবাসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ! সুন্দরী হো হো করে হেসে উঠে বললো, হেসেই উড়িয়ে দেব যদি ভুল পাত্রকে ভালবেসেও ফেলি। : শোন, তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না। : মানুষ মরণশীল। মানুষ ভুলে যায়। : কী বল? হলো কিছু! : মানুষ নিত্য নতুন দিনে ভোরে জেগে উঠে, নতুন নতুন ভালবাসে। : কি বললে এটা? : মানুষ দ্রুতগামী ,দ্রুত ভুলে যায়। : মাথাটা কি গোল হয়ে গেছে। : পা গোল হয়েছে কিনা জানতে চাইছিলো,তাই না! হা হা। ভুলে বললে মাথা গোল। পা গোল। পাগল। আমি পাগলের সাথে আর কথা বলতে চাই না। হাসছে মেয়েটি। উঠে পড়েছে। দ্রুত পা চালিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে পেছন ফিরে চাইল, বললো, : ৩০ দিন সময় আছে। চেষ্টা চালিয়ে যাও। ৩০ দিন পর আমি দেশে চলে যাব। চেঁচিয়ে পেছন থেকে রাতুল বলে উঠলো , : ৩০০ দিন পরও যেতে দেব না। আমি থামবো না। সমুদ্র পেরিয়ে গিয়েও তোমার কাছে যাব। নদীকে আনতে। তুমি পারবে না বয়ে যেতে আমাকে ছাড়া। : আমি রয়ে না গেলেও তোমার এক সময়ে সয়ে যাবে। বলতে বলতে হাসছে সুহাসিনী। প্রেম কি আসলেই এভাবে সয়ে যায়। থমকে যায়,থেমে যায়। না কখনই না। রাতুল না চেঁচিয়ে এবার আপন মনেই বলে, লড়বো আরো ৩০ বছরই লড়বো, তোমাকে পেতে।
×