ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

নগ্ন পায়ের চিত্রকর

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ১৭ জুন ২০১৬

নগ্ন পায়ের চিত্রকর

মকবুল ফিদ হুসেনের শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পের শুরুটা অতি নাটকীয় এবং করুণ। ভাগ্যের অন্বেষণে কিশোর ফিদা বোম্বে শহরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন। অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সিনেমার পোস্টার, বিলবোর্ড ও ব্যানার এঁকে শুরু তাঁর শিল্পী জীবনের যাত্রা। ছবি আঁকায় কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তাঁর। তিনি বিচিত্র আঙ্গিকে, বহুবিধ মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। ১৯৪৭ সালে মুম্বাইতে তাঁর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। তিনি ধর্মমত ভারতীয় পুরাণের ঐতিহ্য, চৈনিক কালি তুলির ছবি, ইতালির রেঁনেসাঁস, ব্রিটিশ জলরঙ, ভারতীয় লৌকিক জীবন, রাজনীতি ইত্যাদি ধারার অনেক কিছু থেকেই আত্মস্থ করে নিজস্ব একটি রূপ নির্মাণ করেছেন। সেই রূপের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় আধুনিকতার বলিষ্ঠ এক নিরীক্ষা তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন স্বদেশ চেতনার ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে প্রকৃত আধুনিকতা। যার প্রকাশ দেখা যায় তাঁর শিল্পকর্মে। তাঁর চিত্রের বিষয় হয়েছে যেমনি বিশেষ ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষ আবার বিষয় করেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন পটভূমিকে। নাটোরের বনলতা সেন, পদ্মানদীর মাঝি, শ্রীকান্তের নৈশ অভিযান এঁকেছেন তিনি। এসব ছবিতে যেমনি রয়েছে কাব্যময়তা আবার সমকালীন নৈপুণ্যে বিস্তৃত করেছে চিন্তার দিগন্ত। ‘বোম্বে প্রগ্রেসিভ গ্রুপে’ থাকাকালীন সময়ে তাঁর চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল কৃষক, শ্রমিক, কুলি, বারবনিতা-বুর্জোয়া সমাজে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত মানবতা। এ সময়ে তিনি আঁকেন কুমার, সকালের স্নান, মহররম, মৌলভী, বলরাম স্ট্রিট প্রভৃতি শিল্পকর্ম। এসব চিত্রে রয়েছে বলিষ্ঠ গতি ও ছন্দময় অনুভূতির প্রকাশ এবং হলুদ, লাল ও বাদামী রঙের উজ্জ্বল দ্যোতনা। ফিদায় আঁকা বিতর্কিত ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ভারতবর্ষের ঠিক জন্মলগ্ন ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু তাঁর সদুীর্ঘ পথচলার মহাকাব্য। দেশ বিভাগের সমসাময়িক সময়ে শিল্পে জাতীয়তাবাদের মতাদর্শের সঙ্কীর্ণ পরিসর ভেঙ্গে আন্তর্জাতিকতার বিশালতা খুঁজতে চল্লিশের দশকের শুরুতে যেসব নবীন সম্ভাবনাময়ী শিল্পীরা এগিয়ে এসেছিল, শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কিন্তু আন্তর্জাতিক আঙ্গিকে শিল্পচর্চার যে ধারা শুরু হয় উপমহাদেশে তার বীজ বপন করে যান কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের রোপিত সেই আধুনিক শিল্পের বীজ থেকে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে আজ যা মহীরুহ তারই অন্যতম এক প্রধান শাখা শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন। আধুনিক চিত্র শিল্পের জগতে পিকাসো, গগ্যাঁ, ভ্যানগগ, দালি একেকটি নক্ষত্র খোচিত নাম। আঠারো থেকে উনিশ শতকে ইউরোপে আধুনিক চিত্রকলার স্ফুরণ ঘটলেও সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যেতে সময় লাগেনি। যদিও ভারতবর্ষে আধুনিক চিত্রকলার যাত্রা বিংশ শতকের মাঝামাঝিতে, আর যাদের হাত ধরে পুরো ভারতবর্ষে আধুনিক চিত্রকলা সত্যিকার শৈল্পিকতার স্পর্শ পায় তাদের মধ্যে মকবুল ফিদা হুসেন অন্যতম। আধুনিক ভারতীয় চিত্রকর্মকে বিশ্ব দরবারে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সত্য, কিন্তু এর জন্য তাকে জীবনের কঠিন স্তরগুলো পেরিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়েছে। দরিদ্রতার জন্য যে ছেলেটি পড়ালেখা করতে পারেনি, যাকে টাকার অভাবে খালিপায়ে গুজরাট ছেড়ে মুম্বাইয়ের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে একটি সুন্দর জীবন প্রাপ্তির তাগিদে সেই ছেলেটিই একদিন হয়ে উঠবে পৃথিবী বিখ্যাত আঁকিয়ে, ফটোগ্রাফার কিংবা চলচ্চিত্রকর তা কি কেউ জানত? ভারতীয় মিথের সঙ্গে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিনিময়ে এক অন্যরকম চিত্রকর্মের জন্ম দেন মকবুল ফিদা হুসেন। ফিদার কাজকে কোন নির্দিষ্ট ধারায় আটকানো কঠিন। সজ্ঞায়িত করাও সহজ নয়। সমসাময়িক শিল্পকলায় ফিদা হুসেনের স্টাইল অনবদ্য ও অনন্য। যা সহজে চিহ্নিত করা যায়। অনেকটা কোলাজের মতো। দ্বিমাত্রিক ফর্মগুলো যেন ভাসমান ক্যানভাসের খোলা আকাশে। মোটা গাঢ় বহিঃরেখা ফর্মগুলোকে আরও বলিষ্ঠতা দেয়। উজ্জ্বল ও সহসী রঙের ব্যবহার তাঁর কাজকে সর্বদা দেয় তারুণ্যের ছোঁয়া। বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন নিজস্ব সংস্কৃতির ও জীবন ধারার ইতিহাস মহাভারত বা রামায়ণের কাহিনী। মায়ের মুখ খুঁজতে গিয়েই বোধ করি সৃষ্টি করেছিলেন মাদার তেরেসার উপর আঁকা সিরিজ চিত্রগুলো। প্রতিটি ছবিতেই মাদার তেরেসাকে মানবসেবায় নিয়োজিত দেখানো হয়েছে। কোন ছবিতেই মাদার তেরেসার স্পস্ট মুখাবয়ব নেই। কোন ছবিতে দেখা যায় মাদার তেরেসার কোলে একটি শিশু শুয়ে আছে। যাকে তিনি সযতেœ হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শিশুটির দেহ, হাত পা লম্বাটে। মাদার তেরেসার পরনের কাপড় সাদা এবং নীল রঙের লাইনের মাধ্যমে বর্ডার এঁকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ব্যাক গ্রাউন্ড লালচে বাদামী রঙে ঢাকা। তাঁর ছবি ছিল মুক্তপ্রাণের বাধাহীন প্রকাশ। তাঁর কোন ঘরানা নেই। গুহামানবের দৃষ্টিতে জগৎ দেখা, জীবনকে দেখা, সেই দেখার আনন্দই তাঁর ছবি। তিনি ব্যাকরণ মানেননি। তাঁর রঙ মেশানোর কৌশল একান্তই তাঁর নিজের। কোন চালাকি, রাখ ঢাক, দুর্বোধ্য কিছুই নেই তাঁর চিত্রে। তাঁর ছবির বক্তব্য অকপট। রঙ ও রেখা বিশেষত সাদা, লাল, নীল ও বাদামী রঙের বলিষ্ঠ ব্যবহার দেখা যায় ছবিতে। ছবি আঁকার সময় সাদা ব্যবহার করে চিত্রের ভেতর আরেকটি চিত্র তৈরি করেন। আর সাদা মানেই সুপার এ্যাডভানটেজ যা পূর্ণাঙ্গতা দেয়। এটা একটা দর্শন। হুসেনের চিত্রকলামূলত বিমূর্ত এবং প্রতীকী। পাশ্চাত্যের বিমূর্ত শিল্পের উৎস শূন্যবোধ থেকে হলেও হুসেনের শিল্প শূন্যতাবোধ থেকে উদ্ভূত নয়। তাঁর চিন্তায় ব্যাপক এক শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। পাশ্চাত্যে বিমূর্ত শিল্পের প্রেরণা এসেছে প্রাগৈতিহাসিক শিল্পকলা, আফ্রিকার নিগ্রো শিল্প, প্রাচীন তীরন্দাজ দলের চিত্রাঙ্কন থেকে আর হুসেনের শিল্পের প্রেরণা যুগিয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামী শিল্পকলা। হুসেনের চিত্রে বার বার বিভিন্ন প্রতীকী অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে ঘোড়া। ঘোড়ার প্রতীককে বহুবিধ জটিল ও বিবিধ অর্থে ব্যবহারের জন্য ভারতীয়, চীন ও পশ্চাত্যের বিভিন্ন ফর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন ফিদা। তাঁর প্রায় ছবিতেই আমরা ঘোড়ার ড্রইং দেখতে পাই। ‘ঘোড়া এবং নারী’ শিরোনামের চিত্রে দেখা যায় খয়েরি বৃত্তের সামনে তেজদ্বীপ্ত একটি ঘোড়া ও একজন নারীকে। ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী ফিগারটিকে নানাভাবে বাঁকিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে আঁকা হয়েছে। যার ফলে বলিষ্ঠ গতি ও ছন্দময় অনুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। হলুদ, বাদামী, সাদা, কালো রঙের বলিষ্ঠ টানের উজ্জ্বল দ্যোতনা চিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘ঘোড়া’ চিত্রেও দেখা যায় একটি তেজদ্বীপ্ত ঘোড়াকে। জীবনী শক্তিতে উজ্জীবিত ঘোড়া চার পা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ফেলে গতিশীলতাকে প্রকাশ করছে। মুখের লাগাম ও লেজের মধ্যেও গতিশীলতাকে তুলে ধরা হয়েছে। বলিষ্ঠ লাইনের মাধ্যমে চিত্রে ভাঙ্গা-গড়া, পুরাতনের উপর নতুন শিল্পের সৃজন দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘ঘোড়া এবং নারী’ ও ‘ঘোড়া’ চিত্রে চীন ও পাশ্চ্যত্যের বিভিন্ন ফর্ম তিনি ব্যবহার করেছেন, পাশাপাশি ভারতীয় ফর্ম ব্যবহার করেছেন। রঙ এবং ড্রইং এ কিউবিক ও পরাবাস্তবাদ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘ঘোড়া’, ‘ঘোড়া ও উত্তোলিত লাল পাঞ্জা’ ‘বাগদাদ’, ‘ঘোড়া প্রধাবিত সূর্য’, ‘ঘোড়া যে ফিরে তাকিয়েছিল’ ইত্যাদি চিত্রে তিনি কখনও পৌরাণিক কখনও কারবালা বা ইসলামের ঐতিহাসিক অথবা চীন ও পাশ্চাত্যের গভীর অনুভূতিতে ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেছেন সমকালীন প্রেক্ষাপটে। বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই তিনি তাঁর ছবির আঙ্গিক ও শিল্পভাষা নির্ধারণ করতেন। তাঁর প্রতিটি ছবিতেই অনুসন্ধানের বিষয়টি স্পষ্ট। হাজার হাজার সঙ্কেত ও চিহ্ন। কখনও কখনও হুসেন ছবি এঁকে আবার মুছে ফেলতেন কিংবা নষ্ট করে ফেলতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হলো- এটা আসলে একটা দীর্ঘ দর্শন। আমি ধ্বংস করি না। এটা এক ধরনের নতুন করে সৃজন। যার গভীরে রয়েছে ভারতীয় দর্শন। যেমন গান্ধীজীর মতো মহান ব্যক্তি এসেছেন এবং তিনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি শেষ হয়ে গেছেন। তিনি এখনও সেখানেই আছেন। আসলে যখন একটা ইমেজ তৈরি করা হয়, তখন তা মানুষের মনের মধ্যে থেকে যায় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী। সেটা ছবি হোক বা ব্যক্তি হোক। সবকিছুই তো নশ্বর। এটা ভাঙ্গা নয়, আরেকটি জীবন দেয়া। বিশ্বব্যাপী তাঁর চিত্রকর্মের কদর। তিনি ভারতের স্বাধীনতা-পরবর্তী শিল্পসংস্কৃতির জগতের অগ্র পথিক। ফিদার শিল্পকর্ম সময়কে জয় করেছে। সমকালীন শিল্পীদের থেকে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। কারণ তিনি রঙতুলির ক্যানভাসের ভেতর নিজেকে আটকে রাখেননি। তাঁর প্রতিভার বর্ণচ্ছটায় আলোকিত হয়ে উঠেছিল শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম। অধ্যবসায় এবং স্বীয় মেধায় তিনি ভারতের চিত্রকলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যান। চিত্রকলায় নিয়ে আসেন বৈচিত্র্য। রঙ তুলিতে ইতিহাস-ঐতিহ্য স্পস্ট করে তোলায় ফিদার জুড়ি মেলা ভার। এ কারণেই সমালোচক, সমার্থক সবাই ছিল তাঁর চিত্রকর্মের সমঝদার। তাঁর আঁকা ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘সরস্বতী’ ও অন্যান্য হিন্দু এবং পুরাণের দেব-দেবীদের বর্ণনামূলক কাহিনীচিত্র, মহাভারতের বা হিন্দু উপাখ্যানের বিভিন্ন চরিত্রের সহজ সাবলীল প্রকাশ ছিল খুবই নাটকীয়। ‘সরস্বতী’ চিত্রে দেখা যায় সরস্বতী বসে বীণা বাজাচ্ছে। ডান হাতে বীণা বাম হাত মুদ্রিত। পরনে উজ্জ্বল নীল, সবুজ, কমলা রঙের শাড়ি। বাম হাতের একটু পেছনে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নৃত্যরত কয়েকটি ফিগার দেখা যায়। সরস্বতীর মাথার কাছেই একটি অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যায়। দূরে নীল আকাশ, আকাশের বুকে একটি চাঁদ। সরস্বতীর ডানপাশে পেখম মেলা অবস্থায় সাদা রঙের একটি ময়ূর দেখা যায়। চিত্রটিতে কিউবিক প্রভাব লক্ষ্যণীয়। ফিদা লোকায়েত প্রতিমা ও ফর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য উপকরণের সফল সমন্বয়, স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফিদা শুধু একজন চিত্রশিল্পীই নন। কবি, ভাস্কর , বাড়ির নক্সাকার হিসেবেও ছিল তাঁর খ্যাতি। আর এদের বাইরে আরও একটি পরিচয় তাঁকে উজ্জ্বল করে রেখেছিল। চিত্রনির্মাতা ১৯৬৭ সালেই তিনি বানালেন প্রথম চলচ্চিত্র ‘থরু দ্য আইস অব এ পেইন্টার’ এবং প্রথমবারেই জিতে নিলেন বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার। এরপর ‘গজগামিনীতে’ মাধুরী দীক্ষিতকে আমরা পাই প্রধান চরিত্রে। সেই শাশ্বত প্রেমিকার চরিত্র, যাকে দেখে কালিদাস রচনা করেন শকুন্তলা আর যাকে দেখেই ভিঞ্চি আঁকেন মোনালিসা। সেই চিরন্তন ভারতীয় নারীর দেখা মেলে কখনও মাতৃরূপে, কখনও প্রেমিকারূপে, আবার কখনও বিদ্রোহীরূপে। সময়ের খেলা থামে না, বয়ে যায় সে, প্রেমিক মন খুঁজে বেড়ায় যুগ যুগান্তরে সেই প্রেমিকার মন, সেই মাতৃরূপী প্রেমিকার ভালবাসা। ফিদার আরেকটি অসাধারণ ক্ষমতা ছিল, তিনি জানতেন কিভাবে তাঁর শিল্পকর্মকে বাজারজাত করতে হয় এবং এই কষ্টসাধ্য কাজটি তিনি নিজেই করতেন। পৃথিবীর বহু নামীদামী অকশন হাউসগুলোতে শিল্পী ফিদা হুসেনের শিল্পকর্ম বিক্রি হয় আকাশছোঁয়া দামে। শিল্পকর্মের মূল্য অনেক বাড়িয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, শিল্পকর্মের অনন্যতাই এর বিক্রির মূল নিয়ামক, দাম নয়। জীবদ্দশায় অনেক ছবি এঁকেছেন ফিদা। জীবনের শুরু থেকে অবধি একই ধারায় কাজ করে গেছেন। ৯৫ বছর বয়সেও তাঁর তুলি কাপেনি এক ফোটাও বয়সের ভারে। সত্তরের দশকে আঁকা তাঁর চিত্রকর্মগুলো পুরো পৃথিবীতে আলোড়ন তুলেছিল। ভারত সরকারও তাঁকে তাঁর সৃষ্টি কর্মের জন্য পুরস্কৃত করে। কিন্তু শেষ জীবনে এসে ভারতীয়দের কাছ থেকেই তিনি চরমভাবে অপমানিত হন। সত্তর দশকে যে চিত্রগুলো বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়েছে, ভারত সরকার যেগুলোর জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করেছে, দেখা গেল সে চিত্রকর্মগুলোই একবিংশ শতকে এসে হয়ে উঠল ভারতীয়দের কাছে বিদ্বেষমূলক। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি দেবী দুর্গা ও সরস্বতীকে নগ্নভাবে চিত্রে উপস্থাপন করেছেন। এত তাদের অসম্মান করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হৃদয়ে তিনি আঘাত করেছেন। প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে কট্টর হিন্দুরা। তাদের আক্রোসের মুখে পড়েন ফিদা। তাঁর বাড়িতে আক্রমণ চালায় হিন্দু মৌলবাদীরা। ভাংচুর করে তাঁর চিত্রকর্ম। আদালতে মামলাও হয়। ফিদার মাথার মূল্য ঘোষণা করা হয় প্রায় ৮ কোটি টাকা। ক্রমাগত বিরোধিতার মুখে তাঁর শিল্পীজীবন ও ব্যক্তিজীবন যন্ত্রণাদায়ক হয়ে পড়ে। ভারত সরকারের দেয়া সরকারী নিরাপত্তার প্রতি তিনি আস্থা রাখতে পারেননি। তাই ২০০৬ সালে দেশ ছাড়েন। চলে যান কাতারে সেখানে তিনি নাগরিকত্বও লাভ করেন। জীবনের শেষ তিনটি বছর তাই তাকে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বাঁচতে হয়েছে। ‘ব্রহ্মপুত্র’ বা ‘মাদার ইন্ডিয়া’ চিত্রকর্মটি ছিল ভারতের মানচিত্র। যা আঁকা হয়েছিল এক নগ্ন নারীর আদলে। এই নগ্ন নারীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে ভারতের রাজ্যগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। ফিদা মনে করতেন নগ্নতা পবিত্রতার প্রতীক। শিল্পের সঙ্গে সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধ চিরকালের। সাধারণ যেখানে সাধারণ দেখে সেই খানে শিল্পী দেখেন শিল্প। মকবুল ফিদা জীবনে শিল্পের সন্ধান করেছেন। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো বা ভ্যানগগের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা হয়। কারণ তিনি আধুনিক সময়ের দৃৃষ্টিতে ভেবেছেন শিল্পীসত্তাকে। তাই তো তাকে ‘ভারত পিকাসো’ বলা হয়। ফিদা হুসেন এক সাহসী পৌরুষের প্রতীক তাঁর বলিষ্ঠ ফর্মগুলোতেই সেই পরিচয় মিলে যায়। তাঁর আঁকা ঘোড়াগুলো দৌড়ে বেড়ায়, দাপিয়ে বেড়ায় সারা ক্যানভাসময় যেন নিজেরই আত্মপ্রতিকৃতি। যেমন সারা বিশ্বময় তার নিজের পৌরুষের দ্বীপ্তিময় প্রতাপ ছড়িয়ে দিয়েছেন। লোহিত নগ্ন নারী, মারাঠীনারী, যাত্রা, সঙ্গীতশিল্পী, হোলি, মা ও সন্তান, মূর্তি পূজারি মেয়ে ইত্যাদি চিত্রে তাঁর রমণীরা জীবনযুদ্ধে পর্যদুস্ত, যন্ত্রণাময়, জর্জরিত, দারিদ্র্যকাতর অথচ অবিচল আস্থায় নির্মল ও সংগ্রামের প্রত্যয়ে দৃঢ়। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৫৫ সালে লাভ করেন ‘পদ্মশ্রী’পদক। ১৯৭১ সালে পাবলো পিকাসোর সঙ্গে সাওপাওলো সম্মেলনে অংশগ্রহণ। ১৯৭৩ সালে ‘পদ্মভূষণ’এবং ১৯৯১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় ফিদা হুসেনকে। ফিদা চিত্রকলাকে নতুন ভাষা দানের অফুরন্ত উৎস হয়ে থাকবেন চিরকাল। যে একদিন যাত্রা শুরু করেছিলেন মাতৃরূপ সদ্ধানে পৃথিবীর প্রান্তে সমস্ত নারীদের মাঝে, সেই যাত্রাকে তিনি পূর্ণতা দিয়েছিলেন দুঃসাহসিক অভিযানে। মনে রাখার মতো জীবন আর শিল্পের অর্ঘ্য তিনি রেখে গেছেন আমাদের মাঝে। যা পৃথিবীর ক্যানভাস ছাড়া অন্য কিছুতে ধারণ করা যাবে না।
×