
ছবিঃ সংগৃহীত
শিশুরা নিখুঁত বাবা-মা চায় না, তারা চায় আপনার উপস্থিতি। হ্যাঁ, এটা এখনই স্পষ্ট করে নেওয়া যাক—কোনো শিশু রাগের মধ্যে চিৎকার করতে করতে বা পোড়া টোস্টের ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে বলে না, “ইস! বাবা-মা যদি একটু বেশি নিখুঁত হতো!” শিশুরা নিখুঁত, ধৈর্যশীল, ঝকঝকে রান্নাঘরসহ মানুষ চায় না। তারা চায়—মানবিকতা, উষ্ণতা আর সংযোগ।
ইনস্টাগ্রামে নিখুঁত পারেন্টিং টিপস বা পিন্টারেস্টের সাজানো লাঞ্চবক্স দেখে আপনার মনে হতেই পারে আপনি পিছিয়ে পড়েছেন। কিন্তু আপনার সন্তানের আসল চাহিদা কী? তা অনেক বেশি সহজ এবং অন্তরঙ্গ।
আপনার ভুলগুলোই হতে পারে সবচেয়ে বড় শেখার উপহার
বিশ্বাস করুন বা না করুন, আপনার ভুল করা এবং সেটা সামলানোর পদ্ধতি দেখেই আপনার সন্তান শেখে জীবনের সত্যিকারের পাঠ। যখন আপনি ভুলবশত অফিস ফাইল মুছে ফেলেন কিংবা স্কুলের ছবি তোলার দিন ভুলে যান, তখন আপনি যদি হাসিমুখে বলেন “ঠিক করে নেব”, তখন আপনি শেখাচ্ছেন কিভাবে বিপদ সামলাতে হয়।
আপনি যদি আপনার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান, তাহলে তারা শিখছে—ভুল করাও স্বাভাবিক, এবং ভুল মানে শেষ নয়। নিখুঁত হওয়া শেখায় না সহনশীলতা, বরং ভুল করে আবার ঘুরে দাঁড়ানো শেখায়।
সময় চাই, কৌশল নয়
শিশুরা আপনার সময় চায়, আপনার অভিনব পারেন্টিং কৌশল নয়। আপনাকে প্রতিটি বই মুখস্থ করতে হবে না, প্রতিটি উইকেন্ড থিম করে সাজাতে হবে না। আপনাকে শুধু তাদের সঙ্গে থাকতে হবে—নিয়মিতভাবে ও মন দিয়ে।
দোকানে একসঙ্গে হাঁটা, রাতে আলো নিভানোর আগে বিছানায় শুয়ে গল্প বলা, কিংবা বিস্কুট বানাতে গিয়ে "আকৃতি বিহীন শিল্প" তৈরি—এই ছোট ছোট সময়গুলোতেই গড়ে ওঠে আসল সংযোগ। শিশুরা মনে রাখে কেমন অনুভব করত আপনার পাশে, আপনার পারফেক্ট ঘরদোর নয়।
তারা চায় এক নিরাপদ আবেগঘন আশ্রয়
শিশুরা ছোট শরীরে অনেক বড় আবেগ অনুভব করে। তারা রাগে, কাঁদে, হতাশ হয়—কখনও ভাঙা বিস্কুট, কখনও সবুজ কাপ না পেয়ে। আপনার দায়িত্ব এই আবেগ “মেরামত” করা নয়, বরং পাশে থেকে বলা: “আমি বুঝছি তুমি কষ্টে আছো। আমি আছি।”
আপনার সংযত আচরণ তাদের শেখায় কিভাবে ভবিষ্যতে নিজের আবেগ সামলাতে হয়। আপনার শতভাগ শান্ত থাকা দরকার নেই, শুধু তাদের জানানো দরকার যে আপনি চেষ্টা করছেন তাদের “ভরসার জায়গা” হয়ে উঠতে।
তারা আপনার বিশ্বাস চায়—ব্যর্থতার সময়েও
সফলতার জন্য বাহবা নয়, আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় যখন কেউ দেখে তার পাশে কেউ আছে, এমন সময়েও যখন সে ব্যর্থ। গণিতে ফেল করুক বা বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হোক, আপনার বলা “তুমি পারবে” কথাটা তাদের ভিতরে এক মজবুত বিশ্বাস তৈরি করে।
তারা নিখুঁত প্রশিক্ষক চায় না, চায় একজন ভুল করা, ভেঙে পড়া, কিন্তু কখনও পাশে না ছেড়ে যাওয়া বাবা-মা। আপনি নিজেকে যেভাবে দেখেন, সেভাবেই গড়ে উঠে তাদের আত্মমর্যাদা। আপনি নিজেকে “আমি তো একেবারে গাধা” বলে ছোট করলে বা নিজের ব্যর্থতায় রূঢ় হয়ে পড়লে, সন্তানরা তা দেখে। আপনি নিজেকে ভালোবাসা, বিশ্রাম দেওয়া, সহানুভূতির আচরণ করলে, তারাও শিখে নিজের প্রতি সদয় হতে।
শিশুদের আত্মমর্যাদা গড়ে তুলতে চান?
তাহলে তাদের দেখান—ভুল হলেও নিজেকে ক্ষমা করা যায়, সাহায্য চাওয়া যায়, কিংবা একদিনের শেষে “আজ আর নয়” বলাও ঠিক।
তারা বেড়ে উঠতে চায় নিজের মতো—জানতে চায়, আপনি তবু ভালোবাসবেন
আমরা প্রায়ই চাই সন্তান হোক আমাদের প্রতিরূপ। কিন্তু তারা নিজস্ব পথ বেছে নিতেই পারে—আলাদা শখ, পছন্দ বা দৃষ্টিভঙ্গি। এটাই স্বাভাবিক এবং সুন্দর। তারা চায় নিঃশর্ত ভালোবাসা, শর্তসাপেক্ষ গ্রহণযোগ্যতা নয়।
তারা জানতে চায়: আমি যদি ভুল করি, আলাদা হই, আপনার প্রত্যাশা পূরণ না করি—তবু কি আপনি আমাকে ভালোবাসবেন?
এই ভালোবাসার মধ্যেই গড়ে উঠে তাদের আত্মবিশ্বাসের শেকড়। সবচেয়ে বড় সত্যটি হলো আপনার সন্তান নিখুঁত বাবা-মা চায় না। তারা চায় আপনাকে—আপনার ভুল, হাস্যরস, পুনরায় চেষ্টা, গভীর আলিঙ্গন ও মনোযোগ।
কেউ মনে রাখে না প্রতিদিন কয় রকম সবজি খেয়েছে, কিন্তু তারা সারাজীবন মনে রাখে—কতটা নিরাপদ, ভালোবাসা ও গুরুত্ব পেয়েছিল আপনার পাশে। নিখুঁত বাবা-মা হওয়া প্রয়োজন নেই। প্রকৃত, মানবিক বাবা-মা হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি।
সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া
নোভা