
ছবি: প্রতীকী
একসময় মানুষ যোগাযোগ করত চিঠির মাধ্যমে, খবর জানত পত্রিকা পড়ে, বিনোদনের জন্য অপেক্ষা করত রাত ৮টার নাটকের। সময় বদলেছে। এখন মোবাইল ফোনেই খবর, বিনোদন, পড়াশোনা এমনকি সম্পর্ক— সবই হাতের মুঠোয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিপ্লব নিঃসন্দেহে মানবসভ্যতার এক বিরাট অর্জন। কিন্তু এই অর্জনের পেছনে কি আমরা কিছু হারাচ্ছি না? হারাচ্ছি নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সহানুভূতি, পারিবারিক বন্ধন এবং আত্মপরিচয়ের বোধ।
বর্তমানে আমরা যে সমাজে বাস করছি, সেটি এক অর্থে ‘ডিজিটাল সমাজ’। এখানে ‘লাইক’, ‘শেয়ার’, ‘ফলোয়ার’ এসব শব্দই যেন সামাজিক মর্যাদার নতুন মাপকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই এখন নিজের জীবনের মূল্য নির্ধারণ করছেন অন্যের রিঅ্যাকশন বা মন্তব্য দিয়ে। অথচ বাস্তব জীবনে তাদের আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস কিংবা নৈতিক অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আজকের প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এমন এক সময়ে, যেখানে ভালো মানুষ হওয়ার চেয়ে ‘ভাইরাল’ হওয়া বেশি জরুরি। নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ কিংবা পরিশ্রম এসব গুণ আজকাল অনেকের কাছে বোকামির প্রতীক। তার বদলে সহজ সাফল্য, তাৎক্ষণিক খ্যাতি আর বাহ্যিক চাকচিক্যই হয়ে উঠেছে জীবনের লক্ষ্য।
একটি স্কুলের শিক্ষক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন যে, এখনকার ছাত্ররা কেন ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছে। তিনি বললেন, “ওদের কাছে এখন সবকিছু ইন্সট্যান্ট— ইন্সট্যান্ট নুডলস, ইন্সট্যান্ট রিলেশনশিপ, ইন্সট্যান্ট ফেম। এই তাড়াহুড়া জীবনের গভীরতা কেড়ে নিচ্ছে।” এই মন্তব্য থেকেই স্পষ্ট— আমরা কেবল প্রযুক্তির মধ্যেই বাস করছি না, আমরা প্রযুক্তির গতি ও মনস্তত্ত্বও আত্মস্থ করে ফেলেছি। এবং এটাই সমস্যার মূল।
একসময় প্রতিবেশী ছিল নিকটজন, আত্মীয় ছিল সম্পর্কের অংশ। এখন প্রতিবেশী কে, জানাও হয় না মাসের পর মাস। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুর সংখ্যা কয়েক হাজার! এই সংখ্যাতেই আমরা খুশি। বস্তুত এই সংখ্যা যেন আমাদের একাকিত্ব ঢাকতে ব্যবহৃত এক আবরণ।
তরুণরা এখন সম্পর্ক গড়ে ফেলে চ্যাটের মাধ্যমে, ভালোবাসা প্রকাশ করে ইমোজিতে, আর বিচ্ছেদ হয় ‘Seen’ দিয়ে। অথচ বাস্তব জীবনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ধৈর্য, ত্যাগ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। এই ভার্চুয়াল সংযোগ আমাদেরকে বাস্তব ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।
প্রযুক্তির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে পরিবার ও শিক্ষার ওপর। আগে পরিবার ছিল মূল নৈতিক শিক্ষার কেন্দ্র। এখন সেখানে মোবাইল ফোন শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষক। বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছেন না কিংবা কাটাতে চাইলেও শিশু প্রযুক্তির চেয়ে অভিভাবকদের কম আকর্ষণীয় মনে করছে।
স্কুল-কলেজে পড়াশোনা এখন অনেকটাই পরীক্ষাভিত্তিক। বইয়ের বাইরের শিক্ষা, চরিত্র গঠন, নৈতিকতা বা জীবনদর্শন গুরুত্ব হারাচ্ছে। শিক্ষকের বদলে ইউটিউব টিচার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেখানে ভালো নম্বর পেতে টিপস শেখানো হয়, কিন্তু ভালো মানুষ হতে শেখানো হয় না।
এই সবকিছুর ফলাফল আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছি। শিশুদের মধ্যে সহিংসতা বাড়ছে, কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে, আত্মহত্যা ও মানসিক রোগের হার বেড়েছে। অনেক তরুণই হতাশাগ্রস্ত, কারণ তারা নিজের জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছে না। তারা জানে কীভাবে ফিল্টার ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু জানে না কীভাবে ব্যর্থতা মেনে নিতে হয়। তারা জানে কীভাবে পপুলার হতে হয়, কিন্তু জানে না কীভাবে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে হয়।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সমাধান আছে, তবে তা সহজ নয়। প্রথমত, পরিবারকে আবার নৈতিক শিক্ষার ঘর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সন্তানকে মোবাইল দিয়ে শান্ত রাখার বদলে তার সঙ্গে কথা বলা, গল্প শোনা, মূল্যবোধ নিয়ে আলাপ করা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাকে হতে হবে চরিত্রগঠনের একটি প্ল্যাটফর্ম। শিক্ষকদের শুধু পরীক্ষার ফল নয়, বরং ছাত্রদের নৈতিকতা, আচরণ ও সহানুভূতির মূল্যায়ন করাও প্রয়োজন। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জীবনের পাঠও শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে।
তৃতীয়ত, সমাজে ইতিবাচক বার্তা ছড়ানো জরুরি। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে মানবিকতা, শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা প্রচার করা যেতে পারে। সেলিব্রেটিদেরও এগিয়ে আসা দরকার— যারা কেবল গ্ল্যামার নয়, মানবিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
চতুর্থত, তরুণদের মধ্যে আত্মসমালোচনার চর্চা গড়ে তুলতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, “আমি কে?”— এই প্রশ্নের উত্তর অন্য কেউ নয়, নিজের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে। নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া, ভুল থেকে শেখা, অন্যকে সম্মান করা— এই গুণগুলো তাদের শেখাতে হবে।
প্রযুক্তি আমাদের অগ্রগতির চাবিকাঠি, এতে সন্দেহ নেই। তবে অগ্রগতির নামে যদি আমরা আমাদের মানবিক সত্তাকে হারিয়ে ফেলি, তাহলে সেই উন্নয়ন হবে আত্মঘাতী। একটি সভ্য সমাজ কেবল প্রযুক্তি দিয়ে গড়া যায় না। তার ভিত থাকে নৈতিকতা, সহমর্মিতা ও আত্মপরিচয়ের ওপর।
আজ আমাদের যে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, তা হলো ডিজিটাল সক্ষমতার সঙ্গে নৈতিক সচেতনতা ও মানবিক দায়িত্ববোধের সমন্বয়। আমরা যদি এটা করতে পারি, তাহলেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি সভ্য, মানবিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.