
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক টুকরো স্বর্গ যেন কমলগঞ্জ। মৌলভীবাজার জেলার এই ছোট্ট উপজেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও জীবন্ত ইতিহাসে পরিপূর্ণ এক লীলাভূমি। এখানে পাহাড়-টিলা, সবুজ চা-বাগান, রহস্যময় বনভূমি, ঝরনাধারা আর আদিবাসী জীবনধারার এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটে, যা ভ্রমণপিপাসুদের মন কারে সহজেই।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান — সবুজের বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস
বাংলাদেশের অন্যতম রেইন ফরেস্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য ভাণ্ডার। এখানে রয়েছে বিরল বৃক্ষরাজি, উল্লুক, মাকড়শা বানর, নানা প্রজাতির পাখি ও পতঙ্গ। বনভূমির আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটলেই চোখে পড়ে সবুজের জাদু, শব্দে মিশে যায় পাখির গান। প্রকৃতির এই নিঃশ্বাসে যে একবার ডুবে যায়, বারবার ফিরে আসতে চায়।
হামহাম জলপ্রপাত — গহিন বনের গোপন বিস্ময়
রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের গহীনে লুকিয়ে থাকা হামহাম ঝর্ণা যেন জলরূপে নেমে আসা এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞান। দুঃসাহসী ট্রেকিং শেষে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা সাদা জলের ধারা দেখে পর্যটকের চোখে আনন্দের জল চলে আসে। বর্ষাকালে এর রূপ হয় আরও বর্ণিল, আরও বেপরোয়া।
মাধবপুর হ্রদ — নীরব জলরাশি, শান্তির প্রতিচ্ছবি
সবুজ টিলার বুক ছুঁয়ে ছুটে যাওয়া মাধবপুর লেক যেন প্রকৃতির নরম হাতে আঁকা ছবি। পাহাড়ের ছায়া পড়ে জলে, সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয় আকাশের নীল। এ এক নীরব সৌন্দর্য, যেখানে বসে থাকা মানে আত্মার শান্তি খোঁজা।
চা-বাগান ও পাহাড়ি পথ — সবুজের সরণি
কমলগঞ্জের দিগন্তজোড়া চা-বাগান শুধু দৃষ্টির আরাম নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিরও প্রতীক। মনুমুখ, আদমপুর, ভানুগাছ বা চাতলাপুর—যেদিকেই যান, সবুজে মোড়া পাহাড়ি পথ আপনাকে আহ্বান জানায় এক অদেখা ভুবনে।
আদিবাসী সংস্কৃতি — রঙে রঙে জীবনের গল্প
কমলগঞ্জের বৈচিত্র্যময় পরিচয়ের বড় অংশজুড়ে রয়েছে এখানকার মণিপুরি, ত্রিপুরা ও খাসি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাঁদের ভাষা, নৃত্য, উৎসব, পোশাক, রান্না ও ধর্মীয় রীতিনীতি এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে করে তুলেছে বহুবর্ণময়। রাসনৃত্য, চৈরাউবা, খাসিদের সোল ফেস্টিভ্যাল—সবই পর্যটকদের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা।
ইতিহাস, সাহস আর শৌর্যের নিদর্শন: সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ যাঁদের একজন—সিপাহী হামিদুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের স্মৃতিকে ধারণ করে আছে সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, যা অবস্থিত কমলগঞ্জ উপজেলার খেত্তুদহ গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী, ইতিহাস অনুসন্ধানী কিংবা কৃতজ্ঞ বাঙালিরা এখানে এসে এক গভীর আবেগে আপ্লুত হন।
সমশেরনগর বিমানবন্দর: ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী
কমলগঞ্জের এক সময়ের প্রাণকেন্দ্র ছিল সমসেরনগর বিমানবন্দর, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ ও মিত্রবাহিনী ব্যবহার করত। আজ এটি পরিত্যক্ত হলেও, এর রানওয়ে, হ্যাঙ্গার ও বাঙ্কারগুলো দেখে এখনো মনে পড়ে যুদ্ধদিনের উত্তাল ইতিহাস। পর্যটকদের জন্য এটি এক ঐতিহাসিক জিজ্ঞাসার জায়গা, যেখানে প্রকৃতি ও অতীত মিশে যায় নীরবতাতে।
রাজকান্দি পাহাড় ও বন: অভিযানের আমন্ত্রণ
কমলগঞ্জের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত রাজকান্দি পাহাড় ও সংরক্ষিত বন বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও জটিল ট্রেকিং রুট হিসেবে পরিচিত। এখানকার গভীর জঙ্গল, পাহাড়ি পথ, বাঁশঝাড় আর বন্যপ্রাণীর ডাকে অভিযাত্রীরা হারিয়ে যান এক অন্যরকম দুঃসাহসে। এখানেই লুকিয়ে আছে হামহাম ঝর্ণাও।
মণিপুরি শাড়ি: শিল্প, ঐতিহ্য আর পরিচয়ের বয়ন
কমলগঞ্জ মানেই মণিপুরি সংস্কৃতি—আর তার কেন্দ্রস্থল হলো এখানকার মনিপুরি শাড়ি বুননের শিল্প। হাতে বোনা এই শাড়ি শুধু বস্ত্র নয়, একেকটি যেন জীবন্ত গল্প। লাল-সবুজ-হলুদ রঙের নিপুণ সংমিশ্রণে তৈরি এই শাড়িগুলোর পেছনে রয়েছে এক বিশাল সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও নান্দনিকতা। পর্যটকরা এখানে এসে শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করেন না, সঙ্গে নিয়ে যান একটি ঐতিহ্য।
কেন যাবেন কমলগঞ্জে?
কমলগঞ্জে গেলে মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজ হাতে গড়েছে এক সৌন্দর্যের মন্দির, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে অপেক্ষা করছে নতুন চমক। যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন, নীরবতা খুঁজেন, সংস্কৃতি আবিষ্কার করতে চান—তাঁদের জন্য কমলগঞ্জ একটি পরিপূর্ণ গন্তব্য।
কমলগঞ্জ শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি অনুভবের এক ভূগোল। এর সৌন্দর্য চোখে দেখা যায়, কিন্তু হৃদয়ে গেঁথে থাকে চিরদিন। তাই যারা সত্যিকারের ভ্রমণপিপাসু, যাঁদের মন খোঁজে প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া—তাঁদের জন্য কমলগঞ্জ এক অব্যর্থ ঠিকানা।
হাজী মো. আব্দুস সামাদ
লেখক ও গবেষক
রাজু