
কোরবানির ঈদ মানেই উৎসবের রঙ, আত্মত্যাগের বার্তা এবং প্রাচুর্যের মাংস। এই দিনে প্রায় প্রতিটি ঘরেই গরু বা ছাগলের মাংস একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে মজুত হয়। অনেক পরিবারেই তা এক-দুই দিনের মধ্যে রান্না না করে দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে খাওয়ার পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই মাংস ঠিক কোন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ভালো থাকবে, তার স্বাদ ও পুষ্টিগুণ অটুট থাকবে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকবে না?
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোরবানির মাংস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে না চললে ফ্রিজে রাখলেও মাংসে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। এতে শুধু যে মাংস নষ্ট হয় তাই নয়, বরং তা খাওয়ার পর ডায়রিয়া, ফুড পয়জনিংয়ের মতো স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তাই মাংস সংরক্ষণের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।
কেন তাৎক্ষণিকভাবে ফ্রিজে দেওয়া ঠিক নয়?
অনেকেই ভুল করে জবাইয়ের পরপরই মাংস ধুয়ে ফ্রিজে রেখে দেন। এটি মোটেই সঠিক পদ্ধতি নয়। পশু জবাইয়ের পর মাংসে এক ধরনের তাপ ও চাপ কাজ করে, যা কিছু সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এ সময়টাকে বলে 'rigor mortis' যেখানে মাংস শক্ত হয়ে যায় এবং এতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়। সাধারণত ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করে মাংস ঠাণ্ডা হয়ে গেলে তবেই সেটিকে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা উচিত।
ধাপে ধাপে কোরবানির মাংস সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি
১. সঠিকভাবে কাটা ও বাছাই:
প্রথমেই মাংসকে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। বড় হাড়সহ মাংস, পেশি, চর্বি ও ভিন্ন ধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (যেমন কলিজা, মগজ, চর্বি) আলাদা করে রাখা ভালো। কারণ এদের সংরক্ষণ পদ্ধতিও আলাদা।
২. অতিরিক্ত চর্বি সরিয়ে ফেলা:
চর্বি বা 'ফ্যাটি টিস্যু' তুলনামূলক দ্রুত পচে যায় এবং সেটির সংস্পর্শে থাকা অন্য মাংসও দ্রুত নষ্ট হতে পারে। তাই বেশি চর্বিযুক্ত অংশ ফ্রিজে রাখার আগে কেটে আলাদা করে রাখা উচিত।
৩. ধুয়ে পরিষ্কার করে পানি ঝরিয়ে ফেলা:
মাংস ভালোভাবে কয়েকবার ধুয়ে নিতে হবে। তবে এরপর ভেজা অবস্থায় কখনই ফ্রিজে রাখা যাবে না। পরিষ্কারের পর মাংস কিছুখন ছায়ায় রেখে পানি সম্পূর্ণ ঝরিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছে নেওয়া যেতে পারে।
৪. এয়ারটাইট প্যাকিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
পানি ঝরানো শুকনো মাংস ফুড গ্রেড প্যাকেট, জিপলক ব্যাগ অথবা এয়ারটাইট কন্টেইনারে সংরক্ষণ করতে হবে। প্লাস্টিকের পাতলা ব্যাগ বা বাজারের সাধারণ প্যাকেটে সংরক্ষণ করলে তা দ্রুত পচে যেতে পারে। একেকটি প্যাকেট যেন একবার রান্নার উপযোগী পরিমাণে হয়, সে অনুযায়ী ভাগ করে রাখা ভালো।
৫. সংরক্ষণের আগে লবণ ও হলুদের ব্যবহার:
চাইলে সামান্য লবণ ও হলুদ মেখে মাংস সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এটি প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে এবং মাংসের রঙ, গন্ধ ও স্বাদ দীর্ঘদিন অটুট রাখে।
৬. ফ্রিজ বা ডিপ ফ্রিজের তাপমাত্রা নিশ্চিত করুন:
ডিপ ফ্রিজের আদর্শ তাপমাত্রা হওয়া উচিত -১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার নিচে। মাংস এ তাপমাত্রায় বরফ হয়ে গেলে ব্যাকটেরিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
৭. ঠাণ্ডা হওয়ার আগে ফ্রিজে নয়:
মাংস পুরোপুরি ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিজে দেবেন না। হঠাৎ গরম মাংস ফ্রিজে রাখলে ফ্রিজের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং অন্যান্য সংরক্ষিত খাবারও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৮. তারিখ ও নাম লিখে লেবেল করুন:
প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে সংরক্ষণের তারিখ এবং মাংসের ধরন (যেমন– হাড়, কিমা, কলিজা) লিখে রাখলে কোনটা আগে রান্না করা উচিত, তা সহজে বোঝা যাবে।
৯. স্টোরেজে সঠিক স্থান নির্বাচন:
ফ্রিজের সবচেয়ে নিচের তাক সাধারণত সবচেয়ে ঠাণ্ডা থাকে, সেখানে বড় মাংস রাখুন। উপরের তাকগুলোতে ছোট টুকরো, কলিজা ও মগজ রাখলে দ্রুত ঠাণ্ডা হবে।
১০. রান্নার আগে সঠিকভাবে ডিফ্রস্ট করুন:
ফ্রিজ থেকে বের করে মাংস কখনই সরাসরি পানিতে ভিজিয়ে বা চুলায় দিয়ে গলানো উচিত নয়। এতে মাংসের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। বরং দুই-তিন ঘণ্টা আগে বের করে নরমাল রুম টেম্পারেচারে রেখে ডিফ্রস্ট করলেই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
কতদিন রাখা নিরাপদ?
সঠিকভাবে সংরক্ষণের মাধ্যমে গরু বা খাসির মাংস সাধারণত ৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। তবে কলিজা, মগজ বা অর্গান মিট বেশি দিন রাখার উপযোগী নয়। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যেই রান্না করে ফেলা ভালো।
কোরবানির মাংস যত্নসহকারে সংরক্ষণ করলে তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাওয়া সম্ভব। সামান্য অসতর্কতা বা ভুল পদ্ধতি পুরো মাংস নষ্ট করে দিতে পারে। তাই সঠিক নিয়ম মেনে সংরক্ষণ করলেই কোরবানির পরও বহুদিন ধরে এই উৎসবের স্বাদ উপভোগ করা যাবে।
আফরোজা