ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ জুন ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

“আমি এনাফ না” থেকে “আমি টু মাচ”, কিশোর মনে আত্ম-সংকট কেন?

ছামিয়া ইসলাম আঁখি

প্রকাশিত: ১৮:৪৪, ৭ জুন ২০২৫

“আমি এনাফ না” থেকে “আমি টু মাচ”, কিশোর মনে আত্ম-সংকট কেন?

ছবি:সংগৃহীত

"আমি কি যথেষ্ট ভালো?", "সবসময় কেন মনে হয় আমি বেশি কিছু হয়ে গেছি?", "সবাই তো আমাকে বুঝেই না!" ,  এ ধরনের প্রশ্ন আজকের টিনএজ কিশোর-কিশোরীদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের এই সংবেদনশীল সময়কে বলা হয় 'আইডেন্টিটি ক্রাইসিস'-এর সময়কাল। এই বয়সে আত্মপরিচয়ের খোঁজে থাকা কিশোরদের মনে জন্ম নেয় তীব্র আত্ম-সন্দেহ, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, বা হতাশা,  যা কখনো আত্মবিশ্বাসে চির ধরায়, কখনো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

 

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের শহুরে অঞ্চলে ১৫-১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ৬১% জানিয়েছে, তারা মাঝেমধ্যে মনে করে তারা “এনাফ” না — অর্থাৎ, তারা নিজেদের অপর্যাপ্ত মনে করে। এর মধ্যে ৩৭% বলেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের 'পারফেক্ট' ছবি ও জীবন দেখে তারা নিজেদের ছোট মনে করে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শারমীন আহমেদ বলেন, “টিনএজাররা এমন একটি পর্যায়ে থাকে, যেখানে তারা চারপাশ থেকে তাদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি খোঁজে। বাবা-মায়ের প্রত্যাশা, শিক্ষার চাপ, বন্ধুদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা ,  সব মিলে একটা চাপের মধ্যে তারা হারিয়ে ফেলে নিজের প্রকৃত মূল্যায়ন।”

 

শুধু নিজেকে 'কম' মনে করাই নয়, অনেক সময় টিনএজাররা নিজেদের ‘অত্যধিক’ মনে করেও সংকটে পড়ে ,  “আমি অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ”, “আমি অতিরিক্ত কথা বলি”, “আমি বেশি সিরিয়াস/বেশি আলাদা”,  এসব অনুভূতি তাদের নিঃসঙ্গ করে তোলে।

বেসরকারি সংগঠন "মন আলো"র এক কনসালটেশন সার্ভেতে দেখা যায়, ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রায় ৪৫% নিজের আচরণ নিয়ে ‘অস্বস্তি’ বা ‘অতিরিক্ততা’ অনুভব করে।

মনোবিদ ও কিশোর পরামর্শক রাকিবুল হাসান বলেন, “এই বয়সে হরমোনের পরিবর্তন, পরিচয়ের সন্ধান, এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা থেকে অনেক কিশোরই ভেতরে ভেতরে 'আমি অদ্ভুত', 'আমি অতিরিক্ত' মনে করতে থাকে। এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব ফেলে।”

 

 

বর্তমান সময়ের টিনএজ মনের সংকট অনেকটাই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত চলা 'তুলনা’র খেলায় উসকে ওঠে। সাইকোলজিক্যাল জার্নাল ‘মাইন্ডস্কেপ’–এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন ২ ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা টিনএজারদের মধ্যে আত্মমূল্যায়নের সমস্যা দ্বিগুণ হয়।

*১৭ বছর বয়সী কলেজছাত্রী আফরিন জানায়*, “ইনস্টাগ্রামে সবাই এত নিখুঁত লাগে — স্কিন, স্টাইল, স্মাইল... সবকিছু। আমি মনে করি আমি কখনো ওদের মতো হতে পারব না।”

 

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিনএজ মানসিক সংকটকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করেই এগোতে হবে। তবে কিছু বিষয় মনোযোগ দিলে এই আত্ম-সন্দেহ কমিয়ে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা সম্ভব, 

*নিয়মিত খোলা মনে কথা বলার পরিবেশ তৈরি করা (পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে)
*নিজের অনুভূতিকে স্বীকার করা ও স্বস্তির জায়গা খোঁজা (যেমন: লেখা, ছবি আঁকা, সঙ্গীত)
*সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সচেতনতা
*মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ গ্রহণ যখন প্রয়োজন হয়

 

টিনএজ হলো রঙিন অথচ জটিল সময়। এই সময়ের “আমি এনাফ না” অথবা “আমি টু মাচ” — এই সংকটগুলো আমাদের সমাজকে বোঝার আহ্বান জানায়। কিশোরদের মন মানেই এক নির্মীয়মাণ আত্মপরিচয়ের খোঁজ। তাই দরকার বোঝার মন, শোনার কান, আর একটি উষ্ণ হাত, যেটি বলবে ,  "তুমি যথেষ্ট, ঠিক যেমন তুমি।"
 

×