ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

গাজাবাসী: ক্ষুধায় মরব, তবুও ’জিএইচএফ’এর সাহায্য নেব না

প্রকাশিত: ১২:৫৩, ২৬ জুন ২০২৫

গাজাবাসী: ক্ষুধায় মরব, তবুও ’জিএইচএফ’এর সাহায্য নেব না

আমার শেষবার রুটি খাওয়ার পর দু'মাস পেরিয়ে গেছে। ইসরায়েল ২ মার্চ থেকে গাজায় প্রায় সমস্ত ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়ার পর বাজারগুলো থেকে খাবার একে একে উধাও হতে শুরু করে। খাবারের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। চিনি আর ময়দা পুরোপুরি মিলছে না, ফলমূল ও সবজিও দুর্লভ, শুধু লাল ডালই বাজারে টিকে ছিল।

জানুয়ারির যুদ্ধবিরতির সময় অনেকে আবার যুদ্ধ শুরু হবে ভেবে খাবার মজুত করেছিল। কিন্তু আমরা—আমার পরিবার—সেই ঝুঁকি নিইনি। এর আগে একবার মজুত করেও সব হারাতে হয়েছিল, যখন ইসরায়েলি সেনারা ট্যাঙ্ক নিয়ে আমাদের এলাকায় পৌঁছায়।সেইসব মুহূর্তে খাবার মাথায় থাকে না। খালি পেট, দুর্বল শরীর—সব ভুলে শুধু প্রিয়জনদের গুনে নিই, সংখ্যা মিললে পালিয়ে বাঁচি।

আমরা নিজের ইচ্ছায় সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু অনেকে তা পারেনি—যেমন শুজাইয়া এলাকা থেকে আসা চারটি পরিবার, যারা এখন আমাদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যদের কেউ ছিল ট্যাক্সিচালক, যার গাড়ি বোমায় উড়ে গেছে; কেউ প্লাস্টিক কারখানার মালিক, কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে; কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় কাজ পায় না; আরেকজন স্ন্যাক বিক্রেতা, যার আর কিছুই বিক্রির জন্য নেই।

সব পরিবারই এখন শুধু লাল ডাল খেয়ে বেঁচে আছে—পানি, ডাল, আর লবণ। তাও চামচ দিয়ে খাই। মাঝেমধ্যে একটু রুটিতে চুবিয়ে খাই, কিন্তু ময়দার দাম গত দুই মাসে এত বেড়েছে

মে মাসের শেষ দিকে, মার্কিন-সমর্থিত GHF (Gaza Humanitarian Food) উদ্যোগ নিয়ে নানা খবরে ছেয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া। বলা হচ্ছিল, প্রতিটি পরিবার সপ্তাহখানেকের জন্য ময়দা, চিনি, বিস্কুট আর টিনজাত খাবার পাবে।

কিন্তু বিতরণ পয়েন্ট মাত্র তিনটি, সবগুলোই রাফায়, ইসরায়েলি সামরিক করিডোর মোরাগ বরাবর। পরে আরও একটি পয়েন্ট খোলা হয় নেটজারিম করিডোরে, যা গাজাকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেয়।

এটা ছিল প্রথম সতর্কতা: কেন অনাহারী মানুষদের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে খাবার আনতে যেতে হবে? কেন সবকিছু শুধু গাজার দক্ষিণ অংশে?

এরপর GHF নিয়ে আরও তদন্ত বের হতে থাকে। ইসরায়েল বলেছে, তারা GHF-এর পেছনে নেই। কিন্তু মার্কিন সূত্র বলছে, এই উদ্যোগ এসেছে সেই দেশ থেকেই, যারা বহুবার খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে—ইসরায়েল।

তবু, ক্ষুধার তীব্রতায় একবার ভাবলাম, GHF-এ যাব। নেটজারিম করিডোর চালু হওয়ার অপেক্ষা ছিল, কিন্তু ওটা একসময় ছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর “কিল জোন”—এখানে যাওয়া ভয়াবহ ঝুঁকির।

রাফার পয়েন্ট চালু হলে যা দেখা গেল, তা ছিল ভয়ানক: ২৭ মে-র প্রথম দিনে ইসরায়েলি গুলিতে অনেকেই নিখোঁজ, তিনজন নিহত, ডজনখানেক আহত। পরে হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যায়।

ইসরায়েল এ ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করে, বলে “অতিরঞ্জিত দাবি,” আর দোষ দেয় হামাসকে—ভুয়া ভিডিও দিয়ে।

নেটজারিম সাইট চালু হলে, আমাদের সামনে দুই ভয়ংকর পথ: জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাওয়া, অথবা না খেয়ে মরার দিক বেছে নেওয়া। প্রথমটিতে যাওয়ার চিন্তা করেছিলাম। সরাসরি গুলিতে মরাও মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে ক্ষুধায় মরার চেয়ে সহজ।

প্রথমে আমাদের বাড়ির পুরুষরা প্রস্তুত ছিল যাওয়ার জন্য। কিন্তু যারা আগেই গিয়েছিল, তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের মন পাল্টে দেয়। পুরো জায়গাটি ছিল সশস্ত্র ডাকাতে ভর্তি, যারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে খাবার লুটে নিচ্ছিল। GHF কর্মীরা আধা ঘণ্টা যেতে না যেতেই ভিড় ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড বোমা ব্যবহার করে।এটা ছিল সংঘবদ্ধ বিশৃঙ্খলা। কে কত পাচ্ছে তার কোনো নিয়ম নেই। যারা শক্তিশালী বা সশস্ত্র, তারা যা খুশি নিয়ে নিচ্ছে।

GHF-এ যাওয়া মানে হলো—অজানা এক অপারেশনে পা রাখা, যা সামরিক জোনে অবস্থিত, সশস্ত্র সেনা ঘেরা, এবং ডাকাতে ভরা, যেখানে হয়তো একটুখানি খাবারও কেড়ে নেওয়া হবে।

লাল ডালের একঘেয়েমি আর ক্ষুধা আমাদের তবু বাধ্য করেনি, এমন সাহায্য চাইতে যা অপমান আর রক্তে মোড়া।

 

উল্লেখ্য - জিএইচএফ একটি মার্কিন-সমর্থিত বেসরকারি সংস্থা, যা দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে ত্রাণ বিতরণ করছে। জাতিসংঘ এবং বড় বড় ত্রাণ সংস্থাগুলো GHF-এর সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, কারণ তারা মনে করে এই সংস্থাটি ইসরায়েলি সামরিক স্বার্থ পূরণের জন্য গঠিত।

 

 

লেখক - এমান হিলিস
গাজা-ভিত্তিক তথ্য যাচাইকারী (ফ্যাক্ট-চেকার)

 

সূত্র - https://www.aljazeera.com/opinions/2025/6/25/im-in-northern-gaza-i-would-rather-starve-than-take-ghf-aid

 

 

 

 

সানজানা

×