ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীর সাফল্যগাথা

প্রকাশিত: ১৬:২৩, ২৬ জুন ২০২৫

ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীর সাফল্যগাথা

ফ্রিল্যান্সিংয়ে তৃষির বাজিমাত ইউটিউবে মানুষ কত কিই না দেখে। একদিন শাশুড়ির মোবাইলে ইফটিউব ভিডিও দেখতে গিয়ে একটি ভিডিওতে তৃষির চোখ আটকে যায়। সেটিতে দেখানো হয়েছিল, ফ্রিল্যান্সিং করে নারীদের সাফল্য। ফ্রিল্যান্সিং কিভাবে ওইসব নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যম হয়েছে সে গল্প। এসব দেখে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ তৃষির মনে ধরে। তিনি আরও এমন অনেক ভিডিও দেখেন। ওই সময় বাসায় ছোট ছেলেকে নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি। ন’টা-পাঁচটা অফিস করার মতো অবস্থা তখন তাঁর ছিল। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তৃষির ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু তাঁর। তিনি লিডিং লাইট নামে একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের কোর্স করেন। লিডিং লাইট তাকে সঠিক পথ দেখায়। তিনি জানতে পারেন, কোন পথে কীভাবে এগোলে সফল্য ধরা দেবে। অবশ্য ফ্রিল্যান্সিংয়ের কোন কাজটি করবেন সেটা তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। সারাক্ষণ তিনি ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে পড়ে থাকেন না। বরং ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি সংসারের যত দায়িত্ব, কর্তব্য। সেগুলো পালনে একটুও উদাসীনতা দেখান না। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি এক ছেলে নিয়ে তাঁর পরিবার। থাকেন ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায়। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ বিভাগে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে গড়ে প্রতি মাসে এক লাখ বিশ থেকে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা ফ্রিল্যান্সিংয়ে তৃষির আয়। তবে শুরুটা তাঁর বলা যায় একদম সাদামাটা। একটা পেজে অর্গানিক ফলোয়ার বাড়িয়ে তিনি মাত্র পাঁচশ টাকা আয় করেছিলেন। তবু এই প্রথম আয় তাঁকে দারুণভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায় বলে তিনি জানান। সর্বোচ্চ এক মাসে তিনি এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করেছেন। এটি ছিল একটি রাশিয়ান কোম্পানির কাজ। দেশি তো বটেই। রাশিয়ান এবং ফিলিপাইনের একটি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছেন অনেকদিন ধরেই। আর দশজনার মতো চিন্তা ধারা তৃষির নয়। তিনি আয় করে তাঁর সব টাকা ভোগ বিলাসে ব্যয় করেন না। বরং বিভিন্নভাবে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ফ্রিল্যান্সিং ছাড়া অন্য খাতে দক্ষতা বাড়াতে চান তিনি। সেজন্য ক্রাফটিংয়ের কিছু কোর্স সম্পন্ন করেছেন কিছুদিন হলো। আবার অনলাইনে পোশাকের একটি পেজ তো তাঁর আছেই। ফ্রিল্যান্সিংয়ে তো বিভিন্ন রকম কাজ। এরই মধ্যে তৃষি বেছে নিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর কাজ। এই কাজের চাহিদার কমতি নেই। কাস্টমার সাপোর্ট স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। লেগো ডিজাইনের কাজেও তৃষির জুড়ি নেই। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব নিয়েও আছে তার নানা রকম কাজ। নারীর জন্য ফ্রিল্যান্সিং অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং। কারণ তাকে শুধু ফ্রিল্যান্সিং করলেই হয় না। বাচ্চা লালন পালনসহ সংসারের অন্য অনেক কাজ করতে হয়। এমনটাই বলছিলেন তৃষি। বাসার সবাই ঘুমালে তখন শুর হতো তৃষির ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ। কখনো কখনো রাত শেষে ভোর হয়ে যেত। এভাবে কঠোর পরিশ্রমের সুফল আজ তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি বলেন, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সব পরিবারের সবাই আমাকে সাপোর্ট না করলে হয়তো আজকের এই অবস্থানে আসা সম্ভব হতো না। বিশেষ করে শাশুড়ি যদি আমাকে না বলত তাহলে হয়তো ভাবি কোনোদিনই এই সেক্টরে আসতে পারতাম না বা আসতাম না। অলস বসে থাকার থেকে কাজ করে আয় করা ভালো মনে হয় আমার কাছে। আমার স্বামী একজন চিকিৎসক এবং সেও চায় আমি যাতে স্বাবলম্বী হই আমার কাজের মাধ্যমে। পরিবারের সবাই আমার কাজ নিয়ে খুব খুশি। নিজে করছেন বলে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তৃষি মনে করেন, যারা গৃহিণী তাদের স্বাবলম্বী হবার জন্য সব থেকে ভালো উপায় হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং করা। স্বাধীনভাবে ঘরে বসেই এই কাজ করা সম্ভব। নারীরা ঘরে শুধু শুধু বসে না থেকে ওই সময়টা স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর কাজে ব্যয় করতে পারেন। স্কিল বাড়লে আয় ও চলে আসে ভালোই। যখন ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজের টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ডে জমা হয়, তখন তৃষির খুব ভালো লাগে। আবার একটা সময় পরিচিত জনদের অনেকেই চাকরি করত। তিনি ঘরে বসে কাটাতেন তখন। সে সময় তার একদমই ভালো যায়নি। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজে নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলবেন। বড় বড় প্রজেক্টের কাজ করবেন। পাশাপাশি ব্যবসাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এমনটাই হলো তার আগামী দিনের পরিকল্পনা।


সংসার সামলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল লুবনা আজকের নারী অন্য সব পেশার মতো ফ্রিল্যান্সিংয়েও সাফল্য পাচ্ছেন। ঘরে বসেই আয় করছেন লাখ টাকা। এমনই একজন সফল ফ্রিল্যান্সার, হবিগঞ্জ সদর থানার বাসিন্দা, এক সন্তানের জননী কাজী লুবনা আক্তার। একটা সরকারি প্রজেক্ট ‘হার পাওয়ার’ ৬ মাসের একটা কোর্স দিয়ে লুবনার ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু। এইচএসসি পাসের পরেই বিয়ে হয়ে যায়। এরপরে ঘর আলো করে বাচ্চা এলে তখন আসলে তার আর বাইরে চাকরি করার মতো অবস্থা ছিল না। মাস্টার্স করার পর ভাবলেন, এমন কিছু করবেন। যেখাানে কারো কাছে জবাবদিহিকতা করতে হবে না। শিখতে গিয়েও পারব কি, পারব না। এমন ভাবতে ভাবতে বেসিক লেবেলর কাজ শেখা হয়ে যায় তার। এজন্য বণিক, সৌরভ নামে দুজনার কাছে তার অনেক কৃতজ্ঞতা। তারা পাশে থেকে সাহায্য করেছেন যখন প্রয়োজন তখন। এক ছেলে, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে লুবনার পরিবার। হবিগঞ্জ সদরের রিচি এলাকায় থাকেন। তার স্বামী পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য। এভভান্স লেবেলের কাজ ও দক্ষতা অর্জনের কোথায় কোর্স করবেন। এজন্য বিভিন্ন জায়গায় লুবনা খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন। অবশেষে খুঁজে পান লিডিং লাইট আইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যেখান তিনি কোর্স চলাকালীন অবস্থায়ই কাজ পান। লুবনা বলেন, লিডিং লাইট আইটির সিনথিয়া আক্তার লিজা আমাকে হাতে ধরে কাজ শেখান। তার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। লিডিং লাইটে কোর্স করার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি লুবনাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, জার্মান, ভারত এই দেশগুলোর বায়ারদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। এগারো শত এর বেশি অর্ডার শেষ করেছেন। ত্রিশটির ও বেশি পেজের এডমিন ছিলেন তিনি। বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট তার একাধিকবার কাজ করিয়ে নেন বলে জানান। স্বাধীনভাবে নিজে কিছু করবেন। যখন তখন যার তাঁর খবরদারি থাকবে না। এমনটাই চাইতেন লুবনা। সে কারণে ফ্রিল্যান্সিং তার খুব পছন্দ হয়। তার ভাষায়, এখানে নিজেই নিজের বস। নিজে স্বাধীনভাবে কাজ করা যায়। কাউকে জবাবদিহিতা করতে হয় না। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, যে কোনো জায়গা থেকে আপনি এই কাজ করতে পারবেন। ২০২৩ সালে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যাত্রা শুরু করে এই বছরই তিনি প্রথম আয়ের দেখা পান। একটি পেজের বিজনেস পেজ ম্যানেজার হিসাবে কাজ করেন। বেতন ছিল ছয় হাজার টাকা। ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে লুবনার কাজ। দেশি ও বিদেশি তিনটি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশসহ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জার্মান, সৌদি আরব, আমেরিকা, ইতালি, সুইডেন ইত্যাদি অনেক দেশের বায়াররা তাকে খুঁজে বের করে কাজ দেয়। লোকালসহ, আউটঅফ মার্কেট প্লেসে তার কাজের অভাব নেই।
ঘরে ছোট সন্তান, শ্বশুর শাশুড়ির দেখভাল অন্যদিকে অফলাইন কোর্সে প্রায় ছয় ঘণ্টা সশরীরে উপস্থিত থাকতে হতো। এমন জটিল পরিস্থিতি হিমশিম খেয়েছেন কিন্তু কখনো ভেঙে পড়েননি। নিজের প্রচুর আগ্রহ আর স্বামীর সমর্থন নিয়ে লক্ষ্য অর্জনে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছেন। পাশাপাশি সব সময় নিজেকে আপডেট রেখেছেন। লুবনা বলেন, স্বামীর সাপোর্ট ও আমার শেখার প্রচুর আগ্রহের কারণে কোনো বাধাই আমার অগ্রযাত্রা রোধ করতে পারেনি। প্রবল মনোবল দিয়ে আমি এই সেক্টরে নিজেকে জয়ী করেছি। নিজেকে দক্ষ করে তোলাই ছিলো তার ধ্যানজ্ঞান। কারণ দক্ষ হলে কাজ জুটবেই। আর কাজ পেলে আয় হবে ভালোই। ২০২৪ সালে এক বছরে তিনি পাঁচ লাখ টাকা আয় করেছেন। এমনিতে মাসে তার গড় আয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। ঠেকে ঠেকে শিখেছেন বলে অন্যদের শেখার পথটা যেন এত কঠিন না হয়। সেজন্য ফ্রিল্যান্সারদের জন্য চারটি টিপস দিয়েছেন তিনি।
এক. কাল শুরু করবেন করবেন করে যারা এখনো শুর করেননি তাদের বলছি সাহস নিয়ে শুরু করুন। 
দুই. ভালো একটা আইটি খুঁজে ফ্রিল্যান্সিং কোর্স করুন। দক্ষতা অর্জন করুন।
তিন. আমি পারব না, আমাকে দিয়ে হবে না, এ ধরনের কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলুন। 
চার. আপনার মনোবল, সাহস ও দক্ষতাই আপনাকে অনেক কিছু দেবে যা আপনি কল্পনাও করেননি।
কাজ করতে গিয়ে লুবনার জীবনে আনন্দময় ঘটনার অভাব নেই। অনেকদিন একটি বিজনেস পেজের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন। ওই পেজের মালিক লুবনার কাজে খুশি হয়ে ২০ হাজার টাকার স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট উপহার দিয়েছেন। লুবনা বলেন, এটা আমার কাছে যেন উপহার নয়, এটা হলো আমার কাজের স্বীকৃতি। যে কোনো পুরস্কার প্রাপ্তি মানেই এক ধরনের স্বীকৃতি, যা কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়। লিডিং লাইট আইটি থেকে দুবার তিনি বেস্ট মার্কেটার নির্বাচিত হয়েছেন। বায়ারদের কাছ থেকে পেয়েছেন বেস্ট সার্ভিস এওয়ার্ড, তাও দুবার। হার পাওয়ার প্রজেক্টে টপ মার্কেটার স্বীকৃতি তাঁর অনন্য অর্জন। বড় একটা স্মার্ট, স্কিলড ও বিশ্বস্ত এজেন্সি খোলার ইচ্ছা তার অনেকদিনের। সেজন্য ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করছেন তিনি। তিনি চান অসংখ্য নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে।

প্যানেল

×