
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অর্থনৈতিক স্বর্গ হয়ে উঠলেও, অস্ট্রেলিয়া যেন দিন দিন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য একপ্রকার ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’-এ পরিণত হচ্ছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশটিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা বিভাগের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে দেশটিতে ১০ লাখ ৯৫ হাজার ২৯৮ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তিরত ছিলেন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। একই বছর নতুন ভর্তি হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার ৯৮৬ জন শিক্ষার্থী যা একক বছরে সর্বোচ্চ রেকর্ড।
টিউশন ফিতে রেকর্ড আয়, শীর্ষে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস
অস্ট্রেলিয়ান ফিনান্সিয়াল রিভিউ (AFR)-এর প্রতিবেদক জুলি হেয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে অস্ট্রেলিয়ার চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ই ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস (UNSW) এক বছরে বিদেশি শিক্ষার্থীদের রাজস্ব আয়ে ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে ৮৭৭ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৪ বিলিয়ন ডলারে।
মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৪২ শতাংশ, আর ডিকিন ও কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ও এক তৃতীয়াংশ আয় বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে মনাশ, ইউনিভার্সিটি অব সিডনি ও মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে UNSW-ও ১ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয়কারী প্রতিষ্ঠানের কাতারে চলে এসেছে।
যেখানে কমেছে চাহিদা, অস্ট্রেলিয়ায় বেড়েই চলেছে
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আকর্ষণে অন্য দেশগুলোর তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার উত্থান চোখে পড়ার মতো। কানাডা ২০২৪ সালে শিক্ষার্থী ভিসার ওপর কোটা প্রয়োগের পর চাহিদা ধসে পড়েছে। যুক্তরাজ্যে ২০২৩-২৪ সালে এক দশকে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ভর্তি কমেছে, কারণ সরকার শিক্ষার্থীদের পরিবার আনার সুযোগ বন্ধ করেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রেও নতুন ভিসা প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। মার্কো রুবিওর নেতৃত্বে দেশটি এখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সংশ্লিষ্ট বা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ভিসা “আক্রমণাত্মকভাবে বাতিল” করছে।
এই প্রেক্ষাপটে, ইউনিভার্সিটিজ অস্ট্রেলিয়া বলেছে, বিশ্বজুড়ে যে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের জন্য অস্ট্রেলিয়া উন্মুক্ত। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী লুক শিহি বলেন, “অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত। যেসব শিক্ষার্থী অন্যত্র সুযোগ হারাচ্ছেন, আমরা তাদের সহায়তা করতে প্রস্তুত।”
শিক্ষামন্ত্রী জেসন ক্লেয়ার আরও বলেন, “যারা সত্যিকারের উদ্দেশ্যে এখানে পড়তে আসতে চান, আমরা তাদের স্বাগত জানাই। আমাদের কিছু বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষা শুধু অর্থ আনে না, বন্ধুত্বও গড়ে তোলে।”
২০২৫ সালেও বেড়েছে চাহিদা, কিন্তু বাড়ছে উদ্বেগও
ডাচ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাডিপোর্টালসের সমীক্ষা বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে অন্যান্য দেশ যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর চাহিদা হারিয়েছে, সেখানে অস্ট্রেলিয়াই একমাত্র বড় গন্তব্য যেখানে চাহিদা বেড়েছে ৮ শতাংশ।
এই জরিপে ৪৮ দেশের ২৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশগুলো চাপে থাকলেও, অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়: জাল কলেজ, ভিসা রুট আর নিম্নমানের অভিবাসন ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ
বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে একধরনের ভিসা-নির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠছে। অস্ট্রেলিয়ার লেবার সরকার এখন শিক্ষার্থী ও গ্র্যাজুয়েট ভিসা সংস্কারে নজর দিতে চাইছে।
প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে আছে– ইংরেজি দক্ষতার মান কঠোর করা, আগাম ভর্তি পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা, আগত শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ জমার প্রমাণ (এসক্রো অ্যাকাউন্ট), কাজের সময়সীমা নির্ধারণ, পার্মানেন্ট রেসিডেন্সির সঙ্গে পড়াশোনা-চাকরির সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্বীকৃত গ্রেড ছাড়া গ্র্যাজুয়েট ভিসা বন্ধ করা।
এছাড়া, জাল প্রাইভেট কলেজগুলো বন্ধ, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের ছাড়া পরিবারের সদস্য আনার অনুমতি বন্ধ এবং অভ্যন্তরীণ রিভিউ প্রক্রিয়া কঠোর করার দাবি উঠেছে।
অস্ট্রেলিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থা এখন যেমন বিশাল রাজস্বের উৎস, তেমনি একটি শৃঙ্খলাবিহীন অভিবাসন ব্যবস্থারও কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। উন্নত গুণগত মান নিশ্চিত না করলে এই জনপ্রিয়তা ভবিষ্যতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এখন দেখার বিষয়, অস্ট্রেলিয়া সরকার সত্যিই কি এই শিক্ষার্থী ভিসার অব্যবস্থাপনা বন্ধে কঠোর হবে, নাকি এই চলমান প্রবণতা আরও গভীর হবে।
সূত্র:https://tinyurl.com/22zhzy67
আফরোজা