
ছবি: সংগৃহীত।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের আক্রমণ শুধুমাত্র হাভার্ডকে নয়, পুরো আমেরিকাকেই দুর্বল করবে—এমনই কথাই বলেছেন কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট ও উদ্ভাবন বিষয়ের লেখক এবং ইয়েল স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টে নেতৃত্ব বিষয়ে শিক্ষক গৌতম মোকুন্দা। তাঁর মতে, হার্ভার্ডের ভূমিকা মার্কিন অর্থনীতিতে যেমন অপরিসীম, তেমনই এটি দেশটির বৈশ্বিক প্রভাব, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমেরিকার শক্তি ও সম্ভাবনাও তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পাবে।
মোকুন্দা বলেন, “যদি চিন বা রাশিয়া এমন একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করতো, যা বছরের পর বছর ধরে কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক মূল্য উৎপন্ন করে, মার্কিন বৈজ্ঞানিক-প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব ধরে রাখতে অবদান রাখে এবং দেশের নরম শক্তি (soft power) বাড়িয়ে তোলে—আমরা নিশ্চয়ই আমাদের সরকারকে এর প্রতিরোধে যুদ্ধবিধ্বস্ত হতে দেখতাম।” কিন্তু বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে, যা হার্ভার্ড নয়, বরং আমেরিকাকে দুর্বল করার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারি চাপ দেয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়। কর্তৃপক্ষের দমন নীতি সবসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও হার্ভার্ডের ইতিহাসের তিক্ততা রয়েছে—উদাহরণস্বরূপ ১৭শ শতকের ইংরেজি গৃহযুদ্ধে পার্ভিটান উগ্রতাবাদীরা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তে থাকা প্রতিমূর্তির টুকরো ভেঙে ফেলে দিয়েছিল—তবে ক্যামব্রিজ এর পরেও টিকেেছিল এবং অনায়াসে অগ্রসর হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েক’শ বছরের হিসাব দিয়ে চলতে শিখেছে, নির্বাচনী চক্রে আটকে না থেকে। ট্রাম্প প্রশাসন যা-ই করুক, হার্ভার্ড চিরকালই থাকবে; কিন্তু হার্ভার্ডের অবদানগুলো যদি আমেরিকা থেকে ছেঁটে নেওয়া হয়, তা হলে দেশটা অনেক দুর্বল হয়ে যাবে।
মোকুন্দা নিজে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে সাত বছর শিক্ষকতা করেছেন এবং এখনও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ফেলোজ প্রোগ্রামে পড়ান। তিনি স্বীকার করেন, “হার্ভার্ড তার আদর্শের অনেকে দিক সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে পারেনি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রতিবেদনগুলো দেখিয়েছে, ক্যাম্পাসে এন্টিসেমিটিজম এবং বিরোধী-ইসলামিক পক্ষপাতিকতার ঘটনা ভীষণ মাত্রায় মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে।”—আর এই পরিস্থিতিতে অনেকেই নিরাপদ শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছেন। এছাড়া ক্যাম্পাসে বাকস্বাধীনতা রক্ষা ও রাজনৈতিক বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করার কথাও উঠেছে৷ “তবে ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্য এই সব সমস্যার সমাধান নয়, বরং হার্ভার্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়া,”—মোকুন্দা মন্তব্য করেন।
তিনি যোগ করেন, “ক্ষমতাবান শাসকেরা সবসময়ই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভয় পেয়ে এসেছে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্তচিন্তার কেন্দ্র এবং প্রতিবাদের ক্ষেত্র। ২০২১ সালে ওহাইও স্টেট ও ইয়েলের সাবেক শিক্ষার্থী জে.ডি. ভ্যান্স ‘দ্য ইউনিভার্সিটিস আর দ্য এনেমি’ শিরোনামে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন—এ তো এরই একটি প্রমাণ। যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন ও ধনী প্রতিষ্ঠানটিকেও ভেঙে দেন, তাহলে আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয় অন্যায়ভাবে দাঁড়াতে সাহস করবে কীনা সন্দেহজনক।”
ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে হার্ভার্ডকে টার্গেট করেছে, সেসব বিবেচনায় তারা এন্টিসেমিটিজমের আলোচনাকে ছলনা হিসেবে ব্যবহার করছে বলে মত গৌতম মোকুন্দার। “শিক্ষামন্ত্রী লিন্ডা ম্যাকমাহন হার্ভার্ডকে সরকারি অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণাপত্রে এন্টিসেমিটিজমের কথা একবারও উল্লেখ করেননি, বরং হার্ভার্ডে রাজনৈতিক দলীয় নেতাদের ফেলোশিপ প্রদানের অভিযোগ তুলেছেন। বর্তমানের চারজন হার্ভার্ড প্রেসিডেন্টের মধ্যে তিনজনই ইহুদি—এমনকি বর্তমানে যারা হার্ভার্ড কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, পেনি প্রিৎসকারও ইহুদি বংশোদ্ভূত,” তথ্যটি তুলে ধরেন মোকুন্দা। “যারা সত্যিই এন্টিসেমিটিজম নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারাও যদি ছিলেন, তাহলে প্রশাসন কি এমন কাউকে চাকরি দিত যারা চেয়ে ইহুদীবিরোধী চরমপন্থীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক জড়িয়ে রেখেছে?”
মোকুন্দা মনে করিয়ে দেন, “সরকার যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে, তবে সেই মুহূর্তেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক মূল্য বিনষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি তখনকার যুদ্ধক্ষেত্রের মতোই, যেখানে নতুন-নতুন উদ্ভাবন আসে স্বাধীন চিন্তা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয়কে মৃতপ্রায় করে দেবে।”
মোকুন্দার মতে, হার্ভার্ডের অবদান মার্কিন ইতিহাসে এতটাই বড়ো যে তার কোনও তুলনা নেই—আটজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, অসংখ্য কংগ্রেস সদস্য, গভর্নর, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সিইও এবং উদ্ভাবক তার ছাত্র-ছাত্রী হয়ে গেছেন। তদুপরি, বিদেশি অঙ্গরাজ্যের অনেকেই হার্ভার্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে চলে গেছেন; বিশ্বমঞ্চে বেজে উঠেছে মার্কিন মূল্যবোধের সুর। “গত ২০ বছরে, নব্য (unicorn) স্টার্টআপে হার্ভার্ড থেকে বার্ষিক গড় ছিল নবটি—বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই এই কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিতে পারেনি। শুধু গত পাঁচ বছরে, হাভার্ডের শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর IPO বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৮২ বিলিয়ন ডলার।” লেখক উল্লেখ করেন, মার্কিন অর্থনীতি ও বৈশ্বিক প্রভাবের জন্য এই অগ্রগতিগুলো অপরিহার্য—আর হার্ভার্ড ছাড়া তা সম্ভব নয়।
একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেন, “আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। ২০২৩ সালে Nature পত্রিকা বিশ্বের শীর্ষ ১০ গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করলে, সেখানে আটটি ছিল চীনের। বাকি দুইটিতে শীর্ষে ছিল হার্ভার্ড। যদি কেউ সত্যিই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বিশ্বাস করে, তাহলে হাভার্ডের ওপর আক্রমণই শেষ কাজ হবে না।”
হাভার্ডের বিশেষ মর্যাদা শুধু অর্থনীতিতেই নয়—বিশ্বজনীন খ্যাতি এবং যথোপযুক্ত গবেষণা ও শিক্ষা পরিচালনায় অতুলনীয়। লেখক নিজে যখন চীনের ‘টিংহুয়া’ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে গিয়েছিলেন, তখন স্থানীয় বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্তরা গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন যেন এলাকা ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে ‘হার্ভার্ড প্রফেসর’ পরিচয়টা গর্বের সাথে দেখানো যায়। “আমি হাসিমুখে বলতাম, অল্প বোঝ এবং ‘এখানে একটা হাতির সামনে আমাকে বাদাম ছিটিয়ে দেওয়া হবে’ এমন অবস্থা হতে পারে,” স্মৃতিচারণা করেন তিনি। হাভার্ডের জনপ্রিয়তার প্রতিফলন ছিল—বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সামাজিক নেতা তাঁদের সন্তানদের পাঠাতে তৎপর থাকেন হাভার্ডে, যেন আমেরিকার ‘মডেল জীবনধারা’ গ্রহণ ও মার্কিন মূল্যবোধ আত্মস্থ করা যায়।
সূত্র: https://short-link.me/-lhp
মিরাজ খান