
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ঘটনা ছিল ১৯৪৫ সালের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা হামলা। ‘লিটল বয়’ নামের যে বোমাটি হিরোশিমায় ফেলা হয়েছিল, তার বিস্ফোরণ শক্তি ছিল প্রায় ১৫ কিলোটন TNT-এর সমতুল্য। সেই একটি বোমাই মুহূর্তে প্রাণ কেড়ে নেয় প্রায় ৮০ হাজার মানুষের, এবং শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ ধ্বংস করে দেয়।
কিন্তু বিজ্ঞান ও সামরিক প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পরমাণু বোমার শক্তিও বহুগুণে বেড়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বের আধুনিক পরমাণু বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই ‘লিটল বয়’-এর তুলনায় ৮০ গুণ বেশি, অর্থাৎ প্রায় ১.২ মেগাটন (১২০০ কিলোটন) TNT সমতুল্য।
প্রশ্ন হলো—এই পরিমাণ ধ্বংসাত্মক শক্তি দিয়ে একটি বোমা বিস্ফোরিত হলে তার ভয়াবহতা কতটা হতে পারে?
একটি ১.২ মেগাটন শক্তির পরমাণু বোমা যদি কোনো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ফেলা হয়, তাহলে বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে অন্তত ৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে সব ধরনের অবকাঠামো—বাড়ি, সেতু, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র—সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাপমাত্রা এতটা বেশি হবে যে মানুষের শরীর মুহূর্তে ভস্মীভূত হবে।
৫ থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে মানুষের শরীর পুড়ে যাবে, অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে পড়বে এবং ব্যাপক রেডিয়েশন ছড়াবে। এমনকি বিস্ফোরণস্থল থেকে ২০ কিমি দূরেও মানুষ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে।
পরমাণু বিস্ফোরণ শুধুই তাৎক্ষণিক প্রাণহানির জন্য নয়, সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হচ্ছে এর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ (radiation fallout)। বোমা বিস্ফোরণের পর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ানক বিকিরণ, যা শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য বা পানির মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ফলে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছরের মধ্যে শুরু হয় ক্যানসার, অঙ্গ বিকলতা এবং শিশুদের মধ্যে জিনগত ত্রুটি।
এ ধরনের বিস্ফোরণে তৈরি হয় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস (EMP), যা কয়েকশ কিলোমিটার জুড়ে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এক ঝটকায় সম্পূর্ণ অচল করে দিতে পারে। এতে শুধু ধ্বংস নয়, গোটা সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ে।
১.২ মেগাটনের একটি বোমা কোনো বড় শহরে ব্যবহৃত হলে শুধু সেই দেশ নয়, আশেপাশের অঞ্চলের পরিবেশেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয় কণার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারমাণবিক শীতকাল (nuclear winter) তৈরি হতে পারে। খাদ্যশস্য উৎপাদন কমে যাবে, জলবায়ু বদলে যাবে এবং বহু মানুষ অনাহারে মারা পড়বে।
‘লিটল বয়’ নামের ছোট্ট বোমার যে ভয়াবহতা বিশ্ব দেখেছিল, তা মানব ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে রয়েছে। আর আধুনিক পরমাণু অস্ত্র সেই ধ্বংসের ক্ষমতা ৮০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এর অর্থ, শুধু একটি বোমাই যথেষ্ট একটি শহরকে সম্পূর্ণ মুছে দিতে, এবং সেই প্রভাব যুগের পর যুগ ধরে মানবসভ্যতার জন্য বিষফল বয়ে আনতে।
বিশ্ব আজ যেখানে রাজনৈতিক সংঘাতে জর্জরিত, সেখানে পরমাণু অস্ত্রের আধুনিকায়ন ও প্রতিযোগিতা নতুন করে বিশ্বনাশের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। এখন সময়—এই ধ্বংসের পথ থেকে সরে এসে শান্তি ও কূটনীতির পথে ফিরবার।
এসএফ