
ছবি: সংগৃহীত
মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন জোহরান মামদানি। একজন মুসলিম অভিবাসী হয়েও নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার টিকিট পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এই বামপন্থি রাজনীতিক। স্থানীয় সময় গত ২৪ জুন অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বের ভোটে তিনি নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোসহ প্রায় ডজনখানেক প্রার্থীকে ধরাশায়ী করেছেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানির এই অভাবনীয় সফলতা নতুন করে আশা জাগাচ্ছে নিউইয়র্কের তিন লাখেরও বেশি দক্ষিণ এশীয় এবং মুসলিম কমিউনিটির মধ্যে। তার এই বিজয়ে তারা মামদানির মধ্যে আপন কারও ছায়া দেখতে পাচ্ছেন, যা তাদের জন্য এক নতুন আশার প্রতীক।
সাড়া জাগানো প্রচার ও সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা
জনপ্রিয় কমেডিয়ান ও মামদানির দীর্ঘ ১৫ বছরের বন্ধু হরি কন্দাবোলু বলেন, "আমার মা তার পরিচিতদের টেক্সট দিয়ে মামদানির জন্য ভোট চেয়েছেন। এমনটা আগে কখনো দেখিনি। এ নির্বাচনে আমাদের পুরো পরিবার সম্পৃক্ত হয়েছে। যেন এটি আমাদের জন্য ব্যক্তিগত বিষয়।" এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়, মামদানির নির্বাচন কতটা ব্যক্তিগত আবেগ ও সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়েছে।
শুরুতে মামদানিকে অনেকেই গোনাতেই নিতে চাননি। তবে সাবেক সিটি গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে এই তরুণ ডেমোক্রেটিক সোশালিস্ট এখন নিউইয়র্কের প্রথম এশীয় ও মুসলিম মেয়র হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
পারিবারিক পটভূমি ও মার্কিন নাগরিকত্ব
ভারতীয় বাবা-মায়ের সন্তান মামদানির জন্ম ১৯৯১ সালে উগান্ডার কাম্পালায়। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। তার মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার এবং বাবা কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি। কুইন্সে বড় হয়ে তিনি নামকরা ব্রঙ্কস হাইস্কুল অব সায়েন্সে পড়াশোনা করেছেন।
হরি কন্দাবোলু আরও বলেন, "নিউইয়র্ক সবসময়ই বৈচিত্র্যের শহর, কিন্তু ৯/১১'র পর থেকে মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয়দের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এই শহর কি আমাদেরও? এখন ২৫ বছর পর সেই একই শহরে একজন দক্ষিণ এশীয় মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পথে। যা সত্যিই অবিশ্বাস্য।"
বর্ণবাদবিরোধী বার্তা ও বৈশ্বিক প্রভাব
ভোটের প্রচারণায় ভারত-পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশীয় এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মামদানি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন। অনেকের কাছে তার জয় বর্ণবাদ ও বিদেশি বিদ্বেষের (জেনোফোবিয়া) বিপরীতে একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে।
দক্ষিণ এশিয়ভিত্তিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম 'দ্য জাগারনট'-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও স্নিগ্ধা সুর বলেন, "মামদানির উত্থান শুধু আমেরিকাতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যেও আলোড়ন তুলেছে।" মিশিগানের বাসিন্দা ও ভারতের জন্ম নেওয়া মুসলিম আমেরিকান থাসিন সরদার মন্তব্য করেন, "এই জয় আমাকে আবারও মানুষ ও জনগণের ওপর আস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে।"
নিউইয়র্কের ভোটার জাইনাব শাব্বির বলেন, "আমার পরিবার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফোন করে বলেছে, এত বড় শহরের মেয়র পদে একজন দক্ষিণ এশীয় মুসলিম জয়ী হওয়া দারুণ ব্যাপার।" শাব্বিরের জন্য মামদানির রাজনৈতিক আদর্শ ছিল বড় কারণ। তিনি বলেন, "তার ক্যাম্পেইন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। অনেক মুসলিমই শুধু দেশের বাইরে রাজনীতিতে আগ্রহী, অথচ এখানেও আমাদের সম্পৃক্ত হওয়া দরকার। মামদানি সেই সুযোগ তৈরি করছেন।"
প্রতিনিধি রো খান্না মামদানির ক্যাম্পেইনের প্রশংসা করে বলেন, "তিনি নিজের শিকড় ও সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাননি। হিন্দি গান, বলিউডের ভিডিওর মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। অথচ তার অর্থনৈতিক বার্তা ছিল খুব শক্তিশালী—বাসা ভাড়া, জীবনযাত্রার ব্যয় ইত্যাদি নিয়ে।" বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তানজিলা রহমান বলেন, "অভাবের মধ্যে নিউইয়র্কে বেড়ে উঠেছি। মামদানির মতো কাউকে দেখে মনে হয়েছে—অবশেষে কেউ আমাদের কথাও শুনছে।"
বিতর্ক ও তরুণ প্রজন্মের শক্তি
ফিলিস্তিন ইস্যুতে তার শক্ত অবস্থান মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়ালেও কিছু ইহুদি সংগঠনের সমালোচনাও কুড়িয়েছেন। এর মধ্যেও কিছু ইহুদি রাজনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্টকে তিনি নিজের পাশে পেয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে প্রকাশ্যে 'যুদ্ধাপরাধী' আখ্যা দিয়ে কিছু মহলে ক্ষোভ ও উদ্বেগ বাড়িয়েছেন মামদানি। তার বিজয়ের পর ডানপন্থি অঙ্গনে আবারও অভিবাসী ও মুসলিম বিদ্বেষে হাওয়া লাগছে।
তবে ভোটের মাঠে তরুণরাই ছিল তার বড় শক্তি। বন্ধু হরি কন্দাবোলু বলেন, "নতুন প্রজন্ম তাদের কণ্ঠস্বর শুনিয়েছে। শুধু ভোট দিয়েই নয়, পরিবার, বন্ধুদেরও যুক্ত করেছে। এটিই তো আসল বিজয়।" এই বিজয় কেবল মামদানির ব্যক্তিগত নয়, এটি নিউইয়র্কের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার এক নতুন রাজনৈতিক জাগরণের ইঙ্গিত বহন করে।
সাব্বির