
শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতো চোখও বিশেষ যত্ন চায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন চোখের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, তেমনি অজান্তেই খাদ্যাভ্যাসের কারণে চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তিও কমে যেতে পারে। তবে গবেষণায় প্রমাণিত, কিছু নির্দিষ্ট ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ খাবার দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে এবং চোখের দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিটামিন ‘সি’, জিঙ্ক, ভিটামিন ‘এ’ এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন ১২টি সুপারফুড সম্পর্কে, যেগুলো চোখের যত্নে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত।
১. মাছ
স্যামন ও টুনার মতো সামুদ্রিক মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, বিশেষ করে ডকোসাহেক্সানোইক অ্যাসিড (DHA)। এই উপাদানটি রেটিনার গঠনের জন্য অপরিহার্য এবং রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়মিত ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ খেলে বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এবং ছানি হওয়ার ঝুঁকি কমে।
২. বাদাম ও বীজ
আলমন্ড, আখরোট, পেকান বাদাম এবং সূর্যমুখীর বীজে রয়েছে ভিটামিন ‘ই’, যা চোখের কোষকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। পিস্তা বাদামে আছে লুটেইন ও জ্যাক্স্যানথিন, এই দুই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চোখের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি প্রতিরোধ করে।
৩. শিম ও ডালজাতীয় খাবার
শিম, মসুর ডালের মতো খাদ্যে আছে জিঙ্ক, যা রেটিনায় মেলানিন নামের একটি রঞ্জক তৈরিতে সাহায্য করে। এটি রাতের অন্ধকারে ভালো দেখার ক্ষমতা বাড়ায় এবং ছানির ঝুঁকি কমায়।
৪. টকজাতীয় ফল
কমলা, লেবু, মাল্টা, জাম্বুরার মতো সাইট্রাস ফল ভিটামিন ‘সি’-তে ভরপুর। এটি কোষের ক্ষয়রোধে কাজ করে এবং চোখে নতুন কোষ গঠনে সহায়তা করে। পাশাপাশি পরিবেশগত দূষণ এবং খাদ্যাভ্যাসজনিত ক্ষতি থেকেও চোখকে রক্ষা করে।
৫. সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি
পালং শাক, কেল বা সরিষার শাক চোখের জন্য উপকারী লুটেইন ও জ্যাক্স্যানথিনের পাশাপাশি ভিটামিন এ, সি এবং কে-তে সমৃদ্ধ। এগুলো চোখের ম্যাকুলা অংশকে রক্ষা করে, যা চোখের কেন্দ্রভাগের স্পষ্ট দৃষ্টি নির্ধারণ করে।
৬. গাজর
গাজরে রয়েছে বিটা-ক্যারোটিন, যা শরীরে গিয়ে ভিটামিন ‘এ’-তে রূপান্তরিত হয়। এই ভিটামিন রাতের অন্ধকারে ভালো দেখার ক্ষমতা বাড়ায় এবং কম আলোয় চোখের দক্ষতা ধরে রাখে।
৭. মিষ্টি আলু
মিষ্টি আলু গাজরের চেয়ে বেশি বিটা-ক্যারোটিন সরবরাহ করে এবং এতে রয়েছে দৈনিক চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি ভিটামিন ‘এ’। এটি চোখের রেটিনাকে আলো সনাক্ত করতে সহায়তা করে এবং শুষ্ক চোখ প্রতিরোধে কাজ করে।
৮. ডিম
ডিমের কুসুমে রয়েছে লুটেইন ও জ্যাক্স্যানথিন, যা ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের অগ্রগতি কমাতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে ২ থেকে ৪টি ডিম খাওয়া এই রোগের ঝুঁকি ৬২% পর্যন্ত কমাতে পারে।
৯. কাঁচা বেল পিপার (মিষ্টি মরিচ)
রঙিন মিষ্টি মরিচে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা চোখের কোষ রক্ষা করে ও রক্তপ্রবাহ সচল রাখে। এটি চোখের সামগ্রিক কার্যকারিতা ও দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখতে সহায়ক।
১০. স্কোয়াশ বা শীতকালীন কুমড়া
এতে ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘সি’ থাকার ফলে চোখের রাতকানা প্রতিরোধে কাজ করে। পাশাপাশি ছানি ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকিও কমায়।
১১. ব্রোকলি ও ব্রাসেলস স্প্রাউটস
এই সবজিগুলোতে রয়েছে ক্যারোটিনয়েড ও প্রচুর ফাইবার। গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করলে ছানির ঝুঁকি প্রায় ২০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
১২. পানি
চোখের অধিকাংশ অংশই পানিতে তৈরি। ফলে শরীর পর্যাপ্ত পানিশূন্য হলে চোখ শুষ্ক হয়ে যায়, ঝাপসা দেখা দেয় এবং চোখে জ্বালাপোড়া হতে পারে। পর্যাপ্ত পানি পান চোখকে সজীব রাখে ও চোখের সার্বিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
চোখের জন্য সবচেয়ে উপকারী পুষ্টি উপাদান কী কী?
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চোখের জন্য ভিটামিন ‘এ’ অপরিহার্য। এটি রেটিনা সুরক্ষা করে ও দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের কোষ ক্ষয় প্রতিরোধে সহায়ক এবং ভিটামিন ‘সি’ পরিবেশ ও খাদ্যাভ্যাসজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
কম চর্বিযুক্ত, ফলমূল ও শাকসবজিতে ভরপুর খাদ্যাভ্যাস চোখের রক্তনালিকে সুস্থ রাখে, ফলে চোখে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে পারে।
কতটা খাওয়া উচিত?
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিন চোখের সুস্থতার জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রয়োজন হয়-
ভিটামিন A: ৯০০ মাইক্রোগ্রাম
ভিটামিন C: ৯০ মিলিগ্রাম
ভিটামিন E: ১৫ মিলিগ্রাম
জিঙ্ক: ১১ মিলিগ্রাম
উদাহরণস্বরূপ, এক কাপ রান্না করা গাজর আপনার দৈনিক ভিটামিন ‘এ’-এর ১০০%-এর বেশি পূরণ করে। এক কাপ কাঁচা ব্রোকলি বা কাটা রেড পিপার ভিটামিন ‘সি’-এর প্রায় ৯০-১০০% পূরণ করে।
চোখের জন্য খাবার ভালো, না সাপ্লিমেন্ট?
যদি খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়া যায়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শে ভিটামিন বা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ধূমপান করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য বিটা-ক্যারোটিনযুক্ত সাপ্লিমেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কারণ এটি ফুসফুস ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ায় বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
চোখের যত্নে অতিরিক্ত কিছু পরামর্শ
নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক ওজন বজায় রাখা, রোদে ভালো মানের সানগ্লাস ব্যবহার, খেলাধুলা বা কাজের সময় নিরাপদ চশমা পরা, ধূমপান ত্যাগ, দীর্ঘ সময় কম্পিউটার ব্যবহারে চোখ বিশ্রাম দেওয়া এবং পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন থাকাও চোখের সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।
চোখ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি। একটু সচেতনতা ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস চোখের স্বাস্থ্যকে দীর্ঘদিন রক্ষা করতে পারে। তাই আজ থেকেই আপনার খাদ্যতালিকায় যুক্ত করুন এই পুষ্টিকর খাবারগুলো এবং নিজে সুস্থ থাকুন, চোখও থাকুক উজ্জ্বল ও সতেজ।
সূত্র:https://tinyurl.com/9fx6zfp3
আফরোজা