
ছবি: সংগৃহীত
প্রতিদিন আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষ থাকেন, যারা শারীরিকভাবে সুস্থ মনে হলেও ভেতরে এক ভয়ংকর যন্ত্রণায় ভুগছেন—এটি হলো মানসিক রোগ। মানসিক রোগ হলো মনের রোগ। এটি এমন একটি অসুস্থতা, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, আবেগ, চিন্তা ও আচরণে প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, বিশ্বের প্রতি ৮ জনে একজন ব্যক্তি কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
মানসিক রোগ কি?
মানসিক রোগ বা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এমন এক ধরনের অসুস্থতা যা একজন ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি, আচরণ এবং পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন), উদ্বেগ (অ্যাংজাইটি), সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, পোষ্ট ট্রমেটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (PTSD), ওবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (OCD) ইত্যাদি এর সাধারণ উদাহরণ।
উপসর্গ
মানসিক রোগের লক্ষণ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে বেশ কিছু সাধারণ লক্ষণ প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে মন খারাপ থাকা বা হতাশা অন্যতম প্রধান উপসর্গ। অনেকেই সবসময় নিজেকে দুঃখে নিমজ্জিত ও নিরাশ অনুভব করেন। অতিরিক্ত ভয় বা দুশ্চিন্তা, যাকে মানসিক উদ্বেগ বলা হয়, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। অনেক রোগী অকারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন বা ছোট ছোট বিষয় নিয়েও অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগেন।
ঘুমের ব্যাঘাত বা নিদ্রাহীনতা একটি স্পষ্ট সংকেত, যা মানসিক অস্থিরতার ইঙ্গিত দেয়। কেউ কেউ ঘুমাতে পারছেন না, আবার কেউ অতিরিক্ত ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। আচরণগত পরিবর্তন যেমন হঠাৎ রেগে যাওয়া, অস্বাভাবিক ব্যবহার, বা কারও প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা—এগুলোও সাধারণ লক্ষণ। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রয়াস, যা অনেক সময় রোগী কারো সঙ্গে ভাগ করে নেন না। এছাড়া, অনেকেই ধীরে ধীরে মানুষ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, একাকীত্বে ভোগেন এবং সামাজিক সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যান।
কী কারণে হয়?
মানসিক রোগ সৃষ্টির পেছনে নানা ধরনের কারণ কাজ করে, যা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জিনগত বা বংশগত কারণ। পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে যদি মানসিক রোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে সেই ঝুঁকি ব্যক্তির ক্ষেত্রেও থেকে যায়। এছাড়া, শারীরিক অসুস্থতা কিংবা মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যের গোলযোগ—যেমন সেরোটোনিন বা ডোপামিন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা—অনেক সময় বিষণ্ণতা বা উদ্বেগজনিত মানসিক রোগের জন্ম দিতে পারে।
শৈশবের ট্রমা, নির্যাতন বা অবহেলার অভিজ্ঞতাও একজন মানুষের মানসিক বিকাশকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করতে পারে। অনেক সময় এসব অভিজ্ঞতা অজান্তেই মনে গেঁথে গিয়ে মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়। পাশাপাশি, সামাজিক চাপ, একাকীত্ব, চাকরি বা জীবনের অনিশ্চয়তা এবং দারিদ্র্য মানসিক চাপকে বাড়িয়ে তোলে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার। এগুলো শুধু মানসিক রোগের জন্ম দেয় না, বরং বিদ্যমান সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
চিকিৎসা
ভালো খবর হলো—মানসিক রোগের চিকিৎসা সম্ভব। এটি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতোই একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য সমস্যা। মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, থেরাপি (যেমন কাউন্সেলিং), ও প্রয়োজন হলে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে সুস্থ করা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগের চিকিৎসায় পরিবার, বন্ধু এবং সমাজের ইতিবাচক সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এখনো মানসিক রোগ নিয়ে প্রচুর ভুল ধারণা ও কুসংস্কার রয়েছে। অনেকে মনে করেন এটি “পাগলামি” বা “অলৌকিক কিছু”। এর ফলে রোগীরা চিকিৎসা না নিয়ে গোপনে কষ্ট পান, যা পরবর্তীতে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও গণমাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারিভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য ও বিনামূল্যে করার দাবিও ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
মুমু ২