
টাইপ ২ ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য প্রতিদিনের খাবারের তালিকা তৈরি করা মানে শুধু শর্করা কম রাখা নয়, বরং এমন কিছু পুষ্টিকর উপাদান বেছে নেওয়া যা শরীরের সামগ্রিক সুস্থতাও নিশ্চিত করে। এ ক্ষেত্রে “সুপারফুড” শব্দটি হয়তো অনেকবারই শুনেছেন। কিন্তু সুপারফুড আসলে কী?
সহজভাবে বললে, সুপারফুড হলো এমন খাবার যেগুলোতে প্রচুর পুষ্টি থাকে বিশেষত ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, আঁশ বা স্বাস্থ্যকর চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে এই ধরনের খাবার প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসে যোগ করা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতেও সহায়ক হতে পারে।
ডায়াবেটিস ও সুপারফুড: সম্পর্ক কী?
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হলেও সেটি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। ফলে গ্লুকোজ বিপাক বাধাগ্রস্ত হয়। জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের মতো বিষয়গুলো এই রোগের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ কারণে স্বাস্থ্যকর, ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য এবং নিয়মিত ব্যায়াম টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বিশেষ সহায়ক। সুপারফুড বলতে মূলত সেই খাবারগুলোকে বোঝানো হয় যেগুলো রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর মধ্যে আঁশ, প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ উপাদান বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই খাবারগুলো হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে, রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতেও কার্যকর। তাই প্রতিদিনের খাবারে নিচের ১০টি সুপারফুড রাখতে পারেন-
১. বিনস বা নানা ধরনের ডাল
বিনস বা বিভিন্ন ধরনের ডাল আঁশে ভরপুর। এটি রক্তে শর্করা, কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। চিলি, পাস্তা, স্যুপ কিংবা ডিপ বানিয়ে সহজেই এই উপাদান খাবারে যোগ করা যায়।
২. সবুজ পাতা জাতীয় শাকসবজি
কলি শাক, পালং শাকের মতো সবুজ পাতা জাতীয় শাক অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। খাবারের সঙ্গে খেলে রক্তে শর্করার আচমকা বৃদ্ধি কম হয়। স্যুপ, সালাদ, ওমলেট বা র্যাপে এগুলো ব্যবহার করতে পারেন।
৩. সাইট্রাস ফল
কমলা, মাল্টা, লেবু বা কাগজি লেবুর মতো সাইট্রাস ফল ভিটামিন সি ও আঁশের ভালো উৎস। ফলটি কাঁচা খাওয়া যায়, আবার সালাদ ড্রেসিং বা মাছ-মাংসে স্বাদ বাড়াতেও ব্যবহার করা যায়।
৪. ফ্ল্যাক্সসিড
গুঁড়ো ফ্ল্যাক্সসিডে রয়েছে স্বাস্থ্যকর চর্বি, আঁশ এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এটি প্রদাহ কমিয়ে রক্তে কোলেস্টেরল ও শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ওটমিল, গ্রানোলা বা বেকিং আইটেমে এটি যোগ করা যেতে পারে।
৫. বেরি ফল
স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি বা রাস্পবেরির মতো বেরিগুলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর। গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলো কোলেস্টেরল, রক্তচাপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ওটমিলে, দইয়ের সঙ্গে বা হালকা ডেজার্টে এগুলো যোগ করতে পারেন।
৬. টমেটো
টমেটোতে রয়েছে লাইকোপেন নামক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। সালাদ, ডিম বা ভাজিতে ব্যবহার করুন, কিংবা ভরে দিন ব্রাউন রাইস ও সবজি, এরপর বেক করে নিন।
৭. ফ্যাটি ফিশ
স্যামন, ম্যাকারেল, ট্রাউট বা অ্যানচোভির মতো ফ্যাটি ফিশে থাকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। ভাজা বা গ্রিল করে এগুলো নিয়মিত খেতে পারেন।
৮. ওটস
ওটসে রয়েছে সল্যুবল ফাইবার, যা কোলেস্টেরল ও রক্তে শর্করা কমাতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া এটি অন্ত্রের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে। ওটমিল ছাড়াও মাফিন বা প্যানকেকে ব্যবহার করতে পারেন।
৯. বাদাম
বাদাম যেমন আখরোট বা আমন্ডে রয়েছে স্বাস্থ্যকর চর্বি, আঁশ ও প্রোটিন। এগুলো দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা স্থির রাখতে সহায়ক। সালাদে ক্রুটনের বদলে বাদাম ব্যবহার করতে পারেন, কিংবা সসে পাইন নাটের মতো বাদাম মিশিয়ে নিতে পারেন।
১০. দই
গবেষণায় দেখা গেছে, দই রক্তে শর্করা কমাতে সাহায্য করতে পারে। এতে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া ইনসুলিন ব্যবহারে সহায়তা করে। গ্রিক দইয়ের সঙ্গে বেরি বা কোকো পাউডার মিশিয়ে ফ্রোজেন দই আইসক্রিমও বানাতে পারেন।
সুপারফুড: বাস্তব নাকি প্রচারণা?
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, এই খাবারগুলো আঁশ, প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর চর্বিতে ভরপুর। এগুলো ভিটামিন ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সরবরাহ করে এবং সাধারণ চিনি ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম থাকে। পাশাপাশি, এদের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সও কম, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তবে একটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি ‘সুপারফুড’ কিছুটা কথার ফুলঝুরি বলেও ধরা হয়। যেমন, একমাত্র কেল শাক ভিটামিন কে’র জন্য বিখ্যাত হয়েছে, বেরি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের জন্য, আবার অ্যাভোকাডো স্বাস্থ্যকর চর্বির জন্য। কিন্তু শুধুমাত্র একটি খাবার দিয়ে রোগ নিরাময় সম্ভব নয়। বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে এগুলোর উপকার সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
পুষ্টিবিদ পূজা মিস্ত্রি বলেন, “একটি খাবার নির্দিষ্ট পুষ্টির আধিক্যের কারণে সুপারফুড হিসেবে পরিচিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এককভাবে এটি কখনোই রোগ প্রতিরোধে যথেষ্ট নয়। এসব খাবার ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য ও নিয়মিত ব্যায়ামের সঙ্গে যুক্ত হলেই কার্যকর হয়।”
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে সুপারফুড খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে সেগুলোর সঙ্গে মৌলিক স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো বজায় রাখা আরও বেশি জরুরি। প্রতিদিনের খাবারে মৌসুমি ফল, শাকসবজি, পূর্ণশস্য এবং লিন প্রোটিন যুক্ত রাখুন। আর খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হলে অবশ্যই পরামর্শ নিন চিকিৎসক বা নিবন্ধিত পুষ্টিবিদের কাছ থেকে। সঠিক খাদ্য পরিকল্পনার মাধ্যমেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব
সূত্র:https://surl.li/wirqoy
আফরোজা