
ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাস মহামারির সময় যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করেছে কিংবা ছোটবেলাটা অতিবাহিত করেছে, তাদের ওপর সেই সময়ের প্রভাব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শুধু মানসিক স্বাস্থ্যে নয়, পড়াশোনা, সামাজিক দক্ষতা এবং ভবিষ্যতের আর্থিক সম্ভাবনায়ও পড়েছে গভীর ছাপ। গবেষকরা বলছেন, মহামারির সময় শিক্ষা বন্ধ থাকার কারণে বর্তমান প্রজন্ম ভবিষ্যতে বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা মনিকার এক প্রি-স্কুল শিক্ষিকা রেবেকা আন্ডারউড লক্ষ্য করেছেন, মহামারির সময়ে জন্ম নেওয়া শিশুরা দৈহিকভাবে অনেক বেশি সতর্ক, খেলাধুলা বা শরীরচর্চায় আগ্রহ কম, এমনকি দুই পায়ে লাফ দেওয়ার মতো সাধারণ দক্ষতাও অনেকে অর্জন করতে পারেনি। আউটডোর এক্সপ্লোরেশন না থাকায় তাদের বিকাশে ব্যাঘাত ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।
২০২০ সালের মার্চে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২.২ বিলিয়ন শিশু-কিশোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে ঘরে বন্দি হয়ে পড়ে। বিদ্যালয়, ক্লাব, খেলাধুলা, এবং সামাজিকতা—সবকিছুই থেমে যায়। শিশুরা মিস করেছে স্কুল প্রম, জন্মদিনের পার্টি, এমনকি গ্র্যাজুয়েশনও। গড়ে স্কুল ৫.৫ মাস বন্ধ ছিল, অনেক ক্ষেত্রে এক বছরেরও বেশি। এতে শিশুদের মানসিক বিকাশে ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
যুক্তরাজ্যে 'বাইসাইকেল' নামের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশুরা ভাষা এবং নির্বাহী কার্যক্ষমতা (যেমন মনোযোগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ) অর্জনে পিছিয়ে রয়েছে। মহামারিকালীন সামাজিক অভিজ্ঞতার অভাবই এই সমস্যার মূল কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা। একঘেয়েমি, বাইরের মানুষের সঙ্গে দেখা না হওয়া, অথবা রাস্তায় লোকজনকে হাত নাড়িয়ে অভিবাদন না করার মতো ক্ষুদ্র বিষয়গুলিও শিশুর বিকাশে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রভাব সবচেয়ে প্রকট। বিশ্বব্যাপী ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবনে বড় বাধার মুখোমুখি হয়েছে। অনেকেই অনলাইনে পড়াশোনা চালালেও প্রযুক্তি সুবিধা না থাকায় পিছিয়ে পড়েছে লাখ লাখ শিশু। ২০২৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গাণিতিক দক্ষতা গড়ে ১৪% হ্রাস পেয়েছে—যা ৭ মাসের শিক্ষার সমান। বিশেষ করে দরিদ্র, অভিবাসী এবং বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই শিক্ষাগত ঘাটতি ভবিষ্যতে আর্থিক ক্ষতির কারণ হবে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি অনুমান অনুযায়ী, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয় কমে যাওয়ার কারণে প্রতিবছর ১২৮ থেকে ১৮৮ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে ক্ষতি হতে পারে।
এছাড়া মহামারির সময়ে শিশুদের শারীরিক স্বাস্থ্যে পরিবর্তন দেখা গেছে। যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১০ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং তা এখনও বিদ্যমান। এতে যুক্তরাজ্যে অতিরিক্ত ৫৬ হাজার শিশু স্থূলতায় আক্রান্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, যার ফলে স্বাস্থ্য খাতে আর্থিক বোঝা বাড়বে।
শুধু শিক্ষাগত বা শারীরিক সমস্যা নয়, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও পড়েছে গভীর প্রভাব। দীর্ঘদিন ঘরে থাকা, বন্ধুদের সঙ্গে না মেলা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, রাগ এবং একাকীত্ব বেড়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব শিশুর বাবা-মা নিজেরাই মানসিক চাপে ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে প্রভাব আরও বেশি ছিল। যারা শরীরচর্চা করেছে, পারিবারিক সম্পর্ক ভালো ছিল বা বিনোদনের সুযোগ পেয়েছে, তারা তুলনামূলক ভালো অবস্থানে ছিল।
তবে কিছু ইতিবাচক দিকও দেখা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সংকট মোকাবেলার মধ্য দিয়ে কিছু শিশু মানসিক পরিপক্বতায় এগিয়ে গেছে। বড়দের আলোচনার মধ্যে থাকা, প্রতিদিন মৃত্যুর খবর দেখা—এসব বিষয় অনেক শিশুকে দ্রুত পরিণত করে তুলেছে।
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, মহামারিকালীন প্রজন্ম এখনো তাদের ক্ষত বহন করছে—চেষ্টা চলছে সেই ঘাটতি পূরণ করার। তবে গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এলে যাতে শিশুরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সে বিষয়ে এখন থেকেই কৌশল গ্রহণ জরুরি। একইসঙ্গে যারা ইতোমধ্যে পিছিয়ে পড়েছে, তাদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ, যেমন ছোট দলে পাঠদান বা টিউটরিং, বিশেষ কার্যকর হতে পারে। যদিও এসব উদ্যোগ ব্যয়বহুল, তবে শিশুদের ভবিষ্যৎ ও সমাজের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মুমু ২