
ছবি: সংগৃহীত
"ডায়াবেটিস" শব্দটা শুনলেই আমাদের মাথায় ভেসে ওঠে চিনি, ইনসুলিন ইনজেকশন আর এক দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার তালিকা। কিন্তু ডায়াবেটিস আসলে শুধু উচ্চ রক্তে শর্করার রোগ নয়—এটি শরীরের ভেতরে চলা এক ধূর্ত ডমিনো খেলা, যেখানে একটির পর একটি বিপদ ধীরে ধীরে এসে পড়ে। একবার রক্তে শর্করা বাড়তে শুরু করলে, অনেক অপ্রত্যাশিত সমস্যা চুপিচুপি শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে।
হয়তো আপনি জানেন যে ডায়াবেটিস হৃদযন্ত্র বা পায়ের সমস্যা তৈরি করতে পারে। কিন্তু জানতেন কি, এটি আপনার ত্বক, স্মৃতিশক্তি এমনকি দাঁতের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে? রক্তে অতিরিক্ত চিনি এমন এক অবাঞ্ছিত অতিথি, যে সঙ্গে করে দশটা নতুন ঝামেলা নিয়ে আসে।
ত্বক সাহায্যের জন্য সংকেত পাঠায়
শুষ্কতা, চুলকানি বা অদ্ভুত র্যাশ? এগুলো শুধু আবহাওয়া বা খারাপ লোশন নয়। উচ্চ রক্তে শর্করা রক্ত চলাচল কমিয়ে দিতে পারে এবং স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে ত্বক সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে সারে। এছাড়া ছত্রাকজনিত ও ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণও বাড়ে, যেমন উরুর সংক্রমণ বা চোখে স্টাই। যদি ত্বকে বারবার সমস্যা দেখা দেয়, বুঝে নিন শরীর কিছু একটা বলতে চাইছে।
ত্বক পরিষ্কার ও আর্দ্র রাখুন এবং এমন ক্ষত উপেক্ষা করবেন না যা দীর্ঘ সময়েও সারে না।
দাঁত ও মাড়ির বিপদ
আপনি যদি ভাবেন ক্যাভিটি শুধু মিষ্টি খাওয়ার জন্য হয়, তাহলে ভুল করছেন। উচ্চ রক্তে শর্করা মুখের ব্যাকটেরিয়াকে খেতে দেয়, যার ফলে মাড়ি ফুলে ওঠা, ইনফ্লামেশন এবং দাঁত পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে মাড়ির সংক্রমণের সম্ভাবনা সাধারণের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি।
তাই দাঁতের যত্ন নিন—নিয়মিত ব্রাশ, ফ্লস ও মাউথওয়াশ ব্যবহার করুন।
মস্তিষ্কের ঝাপসা ভাব মানে শুধু “মন নেই” নয়
ঘরে ঢুকে ভুলে গেছেন কেন এসেছিলেন? বা কথার মাঝপথে খেই হারিয়েছেন? মাঝে মাঝে এমনটা আমাদের হয় ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তে শর্করা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসে স্মৃতিভ্রংশ ও অ্যালঝেইমার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
মস্তিষ্ক স্থিতিশীলতা পছন্দ করে—সুস্থ রাখতে হলে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখুন, পুষ্টিকর চর্বি, শাকসবজি এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন।
হজমের গোলমাল: এটা সত্যিই ঘটে
অবিরাম বমি ভাব, পেট ফেঁপে থাকা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য? এগুলোর পেছনে ডায়াবেটিস থাকতে পারে। উচ্চ রক্তে শর্করা ভেগাস নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা হজম নিয়ন্ত্রণ করে। এতে গ্যাস্ট্রোপারেসিস নামে একটি অবস্থা হয়, যেখানে পাকস্থলীতে খাবার অনেক ধীরে হজম হয়। এতে পুষ্টি শোষণ ও ওষুধের কার্যকারিতাও ব্যাহত হয়।
এ অবস্থায় দিনে কয়েকবার অল্প করে খাবার খান এবং কম চর্বি ও কম আঁশযুক্ত খাবার বেছে নিন।
যৌন স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
এই বিষয়টি অনেকেই বলেন না, কিন্তু উচ্চ রক্তে শর্করা যৌন জীবনের ওপরও প্রভাব ফেলে—নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই। পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি ইরেকটাইল ডিসফাংশনের রূপ নেয়, নারীদের ক্ষেত্রে এটি যোনিশুষ্কতা বা যৌন আকাঙ্ক্ষার অভাবে পরিণত হয়। রক্ত চলাচল, স্নায়ু ও হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় রক্তে শর্করা বাড়লে।
এটি গোপন না রেখে চিকিৎসকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন—সমাধান আছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পাওয়ার অধিকার আপনার আছে।
শ্রবণশক্তির ক্ষয়: এক নীরব সংকেত
বিশ্বাস করুন বা না করুন, কানও উচ্চ রক্তে শর্করার শিকার। গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের শ্রবণশক্তি হারানোর সম্ভাবনা বেশি। কারণ উচ্চ শর্করা কান্নার ভেতরের স্নায়ু ও ক্ষুদ্র রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রথমে টের না পেলেও একসময় টিভির ভলিউম বাড়ানো কিংবা “কি বললে?” বেশি বলার মধ্য দিয়েই এটি ধরা পড়ে। তাই নিয়মিত শ্রবণ পরীক্ষা করান।
মূত্রথলির সমস্যা
ঘন ঘন প্রস্রাব? এটি উচ্চ রক্তে শর্করার সাধারণ লক্ষণ, তবে এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস মূত্রথলির স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে প্রস্রাব ধরে রাখা কঠিন হয়, সংক্রমণ বাড়ে, বা মূত্রথলি পুরোপুরি খালি হয় না। এসব সমস্যা অস্বস্তিকর এবং বিব্রতকরও।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন, সংক্রমণের লক্ষণ দেখলে সতর্ক হোন এবং প্রস্রাব আটকে রাখবেন না।
মানসিক চাপ ও ওঠানামা
শুধু শারীরিক সমস্যাই নয়, ডায়াবেটিস মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করে। উদ্বেগ, বিষণ্নতা, মেজাজ খারাপ—সবই রক্তে শর্করার ওঠানামার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মস্তিষ্ক একটি স্পঞ্জের মতো, যা স্থিতিশীল গ্লুকোজ সরবরাহে ভালোভাবে কাজ করে। তাই হঠাৎ শর্করার ওঠানামা মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।
অসামঞ্জস্য মনে হলে উপেক্ষা করবেন না—মানসিক স্বাস্থ্যও ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ঘুমের ব্যাঘাত
ডায়াবেটিস রোগীদের ঘুম নিয়ে সমস্যা হতেই পারে। উচ্চ রক্তে শর্করার কারণে রাতের বেলা ঘন ঘন প্রস্রাব, ঘাম বা রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম হতে পারে। আবার ঘুমের মাঝে শ্বাস বন্ধ হওয়া বা স্লিপ অ্যাপনিয়ার সঙ্গেও ডায়াবেটিসের সম্পর্ক রয়েছে।
রাতের খাবার হালকা রাখুন, রক্তে শর্করা পর্যবেক্ষণ করুন এবং ঘুম ভালো না হলে স্লিপ অ্যাপনিয়ার পরীক্ষা করান।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
উচ্চ রক্তে শর্করা আপনার রক্তপ্রবাহকে মন্থর করে দেয়, আর এ কারণেই আপনার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীর হয়ে যায়। ফলে ক্ষত সারে না, সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হয়। এমনকি ছোট একটি কাটা-ছেঁড়া বা ফোড়া থেকে বড় বিপদও হতে পারে।
ক্ষত বা সংক্রমণকে হালকাভাবে নেবেন না—আপনার শরীর যা বলছে, তা শুনুন।
চিনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে মিষ্টি নয়
ডায়াবেটিস মানে শুধু গ্লুকোমিটারে দেখা সংখ্যা নয়। এটি মাথা, ত্বক, হজম, মেজাজ, যৌনতা, ঘুম এমনকি শ্রবণশক্তি পর্যন্ত সবকিছুর সঙ্গে জড়িত। এই জটিলতাগুলো হুট করেই দেখা দেয় না, বরং চুপিসারে শরীরে প্রবেশ করে—যখন রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ নেই।
ভালো খবর হলো—এই সমস্যাগুলোর অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য বা নিয়ন্ত্রণযোগ্য, যদি আপনি নিয়মিত কয়েকটি কাজ করেন:
-
রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখুন
-
আঁশযুক্ত, প্রাকৃতিক খাবার খান
-
প্রতিদিন শরীরচর্চা করুন
-
ছোট হলেও অস্বাভাবিক উপসর্গকে অবহেলা করবেন না
-
চিকিৎসকের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন
ডায়াবেটিস থাকলে জীবন শেষ হয়ে যায় না। বরং এর মানে হলো, আপনাকে আপনার শরীরকে একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে, আরেকটু ভালোবাসতে হবে। আর এই যত্নটাই আপনার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।
আবির