ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশুর মনের আবেগ ও ভাষা

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ২৫ জুন ২০১৯

  শিশুর মনের আবেগ ও ভাষা

বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত ধারণা থেকে যখন আমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হই তখন সামাজিকতা সম্পূর্ণ করতে একজন আরেক জনকে প্রশ্ন ‘করি কেমন আছেন’? অথবা বলে থাকি ‘ভাল থাকবেন’। অর্থাৎ যে কোন মানুষের ‘সুস্থতা’ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় অথবা ‘সুস্থতা’ কামনা করা হয়। সুস্থতা বলতে আসলে আমরা কি বুঝি অথবা সুস্থতা বলতে কি বোঝায়। সুস্থতা বলতে কি বোঝায় যে কোন গড়নের একজন স্বাস্থ্য ভাল মানুষ কে? আলোকপাত করা যাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুস্থতাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে : Health is a state of complete Physical, Mental and Social Well-being, not merely an absence of diseases or infirmity. অর্থাৎ শুধু শারীরিকভাবে একজন মানুষ সুস্থ হলেই হবে না তাকে মানসিকভাবেও সুসাথ হতে হবে এবং সামাজিকভাবে কর্মক্ষম হতে হবে। সুতরাং শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের এবং সামাজিকতার সম্পর্ক নিবিড়। কারণ এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড যত মানব জাতি আছে সকলেরই একটা ‘মন’ আছে মন ছাড়া কোন মানব জাতির অস্তিত্ব অকল্পনীয়, কারণ : ১) মনের অবস্থান আমাদের মস্তিষ্কে এবং যার প্রারম্ভিক বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভে, অর্থাৎ শুক্রাণু ও ডিম্বানু নিষেকের পর, ভ্রুণ অবস্থায় মাতৃগর্ভে আসার প্রথম তিন সপ্তাহের মধ্যে মস্তিষ্ক তথা স্নায়ুতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর এ জন্যই গর্ভাবস্থ্য়া পরিবারের সবাইকে মায়ের সঙ্গে ভাল আচরণ, সঠিক যত্ন এবং বিনোদনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। ২) একটি স্বাভাবিক শিশু ৫ মাস বয়স থেকেই কানে শুনতে পায় এবং মনের স্বাস্থ্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো ‘আবেগ’। এই আবেগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় ‘ইতিবাচক আবেগ’ (আদর, ভালবাসা, মায়া, মমতা, সুখ, আনন্দ) এবং ‘নেতিবাচক আবেগ’ (রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, কষ্ট) ইত্যাদি, এই আবেগগুলো স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। ৩) যে কোন মানুষই তার চিন্তার বহির্প্রকাশ করেন আবেগের মাধ্যমে শুধু যে চিন্তারই বহির্প্রকাশ করছেন তা নয় সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকতা সমর্পণ করছেন। আর ভাষা হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। হোক তা বাচনিক অথবা অবাচনিক উপায়ে কিন্তু এই ভাষার বহির্প্রকাশ হতে হবে প্রতিবেশ এবং পরিবেশ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট আর একেই বলে সামাজিকতা। ৫) মন থাকে মস্তিষ্কে মনের সঙ্গে নিউরনের সম্পর্ক নিবিড়। যদিও এই নিউরনের গঠন শুরু হয় মাতৃগর্ভে কিন্তু নিউরনের সঙ্গে নিউরনের আন্তঃকোষীয় সংযোগ বা সাইনাপটিক কানেকশন (Synaptic Connection) শুরু হয় জন্মের পর এবং সম্পূর্ণ হয় তিন বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ, ৫ বছর পর্যন্ত নিউরনগুলো একে অপরের সঙ্গে অবিরাম যুক্ত হতে থাকে এই সংযোগগুলো একটি ‘স্নায়ুবিক নেটওয়ার্ক’ তৈরি করে এই স্নায়ুবিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে ‘জিন’ অর্থাৎ বংশগতির ধারক ও বাহকের সম্পৃক্ততা ৫) মস্তিষ্কের বিকাশ শুধুমাত্র জিনের কারসাজি নয় বরং একটি শিশু পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে কি ধরনের উদ্দীপনা এবং অনুপ্রেরণা পেল তার ওপর হতে পারে এই উদ্দীপনা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক \ ৬) মন হচ্ছে মস্তিষ্কের আন্তঃকোষীয় সংযোগের মাধ্যমে নিউরন থেকে নিউরনে ইলেকট্রনের অনুরণ মাত্র যার বহির্প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হলো ভাষা। আর এ কারণেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়, মন ও ভাষার সম্পৃক্ততা মস্তিষ্কের আন্তঃকোষীয় সংযোগের সঙ্গে। এটি শিশু ভবিষ্যতে কি হবে তা নির্র্ভর করে জন্মের প্রথম ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত একটি শিশু তার নিজ পরিবার এবং পারিপাশ্বির্ক পরিবেশ থেকে কি ধরনের অনুপ্রেরণা পেল তার ওপর। ৭) মস্তিষ্কের আন্তঃকোষীয় সংযোগের মধ্যে যে সংযোগগুলো জন্মের পর বার বার ব্যবহৃত হয় সেই সংযোগগুলো দীর্ঘকাল টিকে থাকে এবং যে সংযোগগুলো অব্যবহৃত হয় সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের সন্তানদের উদ্দীপনা দেয়ার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ভাষার মাধ্যমে আমরা তাকে কি ধরনের উদ্দীপনা দিচ্ছি যা শিশুর মন অর্থাৎ মানসিক বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে কারণ আজকের শিশুই পরবর্তী প্রজন্মের জাতির ভবিষ্যত। ডাঃ ফাহমিদা ফেরদৌস মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা ভাষাবিদ সহকারী অধ্যাপক (মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ) জেড.এইচ সিকদার ওমেন্স মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
×