
আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নেওয়া হবে
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইনি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিদল যুক্তরাজ্য সফর করেন। ওই সময় পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মুনসুর।
এ প্রসঙ্গে গভর্নর জানান, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের কাছ থেকে পারস্পরিক আইনি সহায়তার অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাচারকারীদের সম্পত্তি এবং লুট করা অর্থ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছে। সম্প্রতি, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে ১৭০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে। এর পাশাপাশি গত মাসে দেশটিতে বেক্সিমকো গ্রুপের শায়ান রহমান এবং শাহরিয়ার রহমানের ৯০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদ জব্দ করা হয়। সবমিলিয়ে যুক্তরাজ্যে ২৬০ মিলিয়ন পাউন্ড জব্দ করা হয়েছে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মামলা-মোকদ্দমায় দক্ষ আইনি সংস্থাগুলো সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য ৫০ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এ সংক্রান্ত মামলার তহবিল দাতারা হচ্ছেন তৃতীয় পক্ষ, তারা মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত আইনি খরচ নির্বাহ করতে এবং মামলার মাধ্যমে পুনরুদ্ধার হওয়া অর্থের একটি অংশের বিনিময়ে মামলাকারীকে আর্থিক সহায়তা করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মুনসুর আরও বলেন, বাংলাদেশ এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে একটি তহবিল গঠনের কথা বিবেচনা করবে, পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী আইনি সংস্থাগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে। তিনি জানান, ‘তারা (আইনি সংস্থাগুলো) উদ্ধারকৃত অর্থের ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পাবে। তবে কি পরিমাণ অর্থ উদ্ধার হবে তার ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত হবে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য দেশের সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে। আশা করছি, একটি ভালো পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করা যাবে।
এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহায়তা করছে যুক্তরাজ্য। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নিবিড় আলোচনা করছে সরকার। তারা নথিপত্র তৈরিতেও আমাদের সহায়তা করছে।
উল্লেখ্য, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েই সেই অর্থ বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। পাচারকৃত এই অর্থের পরিমাণ ১৮-২০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যা ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। পাচার হওয়া এই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এ লক্ষ্যে আমলতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনতে এ সম্পর্কিত আইন পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে সেসব দেশের সরকার প্রধানের কাছে পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সহযোগিতা চাওয়া হবে। এদিকে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মোট ১৭ হাজার ৩৪৫টি সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন (এসটিআর/এসএআর) দাখিল হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় যা প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি।
এতে বোঝা যায়, অর্থ পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমে প্রতিবেদন প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সচেতনতা ও দক্ষতা বেড়েছে। এছাড়া বিএফআইইউ গত অর্থবছরে ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়েছে। আইন প্রয়োগকারী, নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মোট ১ হাজার ২২০টি তথ্য বিনিময়ও হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে এর মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম।
তবে এসব অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোও বেশ তৎপরতা দেখাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ জব্দ করে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী তিন সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), স্পটলাইট অন করাপশন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে। সংস্থাগুলো ব্রিটিশ সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানায়। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার শান্তি পুনরুদ্ধার ও জবাবদিহি নিশ্চিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যদিকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ‘অর্থ পাচারের স্বর্ণযুগ শেষ হয়েছে’ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন।
স্পটলাইট অন করাপশনের নির্বাহী পরিচালক সুসান হাওলি ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, সময় নষ্ট না করে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ জব্দে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একইসঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও অর্থ পুনরুদ্ধারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। উল্লেখ্য, দ্য অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকের তদন্তে যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের মালিকানাধীন কমপক্ষে ৪০ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচার ও হু-ি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও লেনদেন ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই প্রবণতা। অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কাজ চলছে। ১১টি গ্রুপ নিয়ে যৌথ তদন্ত চলছে।