
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে উপদেষ্টারা বলেছেন, পূর্বের যেসব জঞ্জাল পেয়েছি, সেগুলো আগে পরিষ্কার করতে হচ্ছে। পূর্ববর্তী সরকারের সময় নেওয়া সব প্রকল্পেই দুর্নীতি হয়েছে, তারপরও আমরা সব ক’টি বাদ দিতে পারিনি। নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠেছিল অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট।
এসব সমস্যা তো একদিনে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। তবে মেঠোপথ পেরিয়ে মহাসড়কে ওঠার যাত্রা শুরু হয়েছে মন্তব্য করে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা যে পদচিহ্ন রেখে যাব (ফুটপ্রিন্ট) আশা করছি- পরবর্তীতে যারা আসবে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দাবি করেছেন, এটা সম্পূর্ণ বাস্তবায়নযোগ্য, বাস্তবসস্মত ও মিতব্যয়ী বাজেট।
ভবিষ্যতে শাক-সবজির দাম যাতে আর না বাড়ে সে লক্ষ্যে ১০০টি হিমাগার তৈরির উদ্যোগের কথা জানান, কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। ইতোমধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, এটা অপচয় কমানোর বাজেট, এটা অসঙ্গতি কমানোর বাজেট।
মঙ্গলবার বেলা ৩টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টারা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এর আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বাজেট নিয়ে সংক্ষিপ্ত ব্রিফ করেন।
ওই সময় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতির কথা তুলে ধরে কঠোর সমালোচনা করা হয়। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, অর্থ সচিব খায়েজ্জামান মজুমদার, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান।
সংবাদ সম্মেলনে দেশের জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন, অনলাইন মিডিয়া এবং রেডিওতে কর্মরত সাংবাদিকরা অংশগ্রহণ করেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা, প্রবৃদ্ধি, কর ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও খেলাপি ঋণ আদায়ের পদক্ষেপসহ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন আসে সাংবাদিকদের কাছ থেকে। অর্থ উপদেষ্টার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও আমলারা এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা ক্ষমতা নেইনি, দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্বটা একটা কঠিন সময়ে নিয়েছি। দেশের এখন ক্রান্তিলগ্ন, অনেকেই বলেছেন দেশ আইসিইউতে ছিল, খাদের কিনারে চলে এসেছিল। বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। সে সময় যদি আমরা দায়িত্ব না নিতাম তাহলে কি হতো? তিনি বলেন, যাই হোক আমরা চেষ্টা করে সবাই মিলে দেশটাকে একটা স্থিতিশীল অবস্থান নিয়ে আসতে পেরেছি। যে সংস্কারগুলো আমরা হাতে নিয়েছি সেটা চলমান। আমরা যতটুকু পারি করব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী এই অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতিকে সঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।
কালো টাকা এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, যারা অর্থপাচার করে তারা খুবই বুদ্ধিমান। বিভিন্ন ধাপে অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়ার টাকা ফেরত আনা অত সহজ হবে না। সময় লাগবে, তবে সরকারও চেষ্টা করে যাচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অনেকেরই প্রশ্ন কালো টাকা (অপ্রদর্শিত আয়) ঢালাওভাবে সাদা করতে দেওয়া হচ্ছে। কালো টাকা কিন্তু কালো টাকা না, অপ্রদর্শিত অর্থ। কোনো কারণে হয়তো রয়ে গেছে বা প্রদর্শন করা হয়নি। শুধুমাত্র ফ্ল্যাটের বিষয়ে একটা বিধান নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত সম্পদ বা কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখলেও সেজন্য করের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে।
আগের বিভিন্ন সময়ে যে প্রবৃদ্ধি নির্ভর বাজেট দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে এবার সরকার বের হয়ে এসেছে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা সাধারণ প্রবৃদ্ধিতে না গিয়ে সাধারণ মানুষের যাতে জীবন মানোন্নয়ন, ব্যবস্থা বাণিজ্য ভালোভাবে করা যায় সেদিকে জোর দিয়েছি। প্রথমবারের মতো এবার বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় বাড়েনি।
তিনি বলেন, এই মাসের মধ্যে বাজেট অনুমোদন হবে। তার আগে বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নেওয়া হবে। অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, আমাদের সম্পদ সীমিত, চাহিদা অনেক বেশি। বাইরে থেকে সম্পদ আনা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, পুঁজিবাদের অবস্থা, ব্যাংকের অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা। এর ভেতরেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে কিন্তু আমরা বাজেট করিনি। আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল যেমন- মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকিং খাত, জ্বালানি খাত, রাজস্ব আদায় এসব কিছুর মধ্যেই বাজেট করতে হয়েছে। তারপরও আমাদের প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার বাড়েনি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে ॥ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সেই সময় বেশিরভাগ প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন করে বাদ দেওয়া হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর অনেক ঠিকাদার পালিয়ে গেছে। ফলে কি কাজ হচ্ছে কেন হচ্ছে সেটাই বোঝা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় নতুন বাজেটে কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। আগের আগের মেগা প্রকল্পগুলোতে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। এমন কোনো প্রকল্প নেই যেখানে দুর্নীতির ছোঁয়া লাগেনি। পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল এবং অনেক প্রকল্পে অর্থ সংস্থানও বিবেচনা করা হয়নি।
মূল্যস্ফীতি বাজেট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কমবে ॥ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে এবং গড় মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে ধরে রাখার কথা বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট থেকে এখন ৮.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ১১.৫ শতাংশ থেকে সোয়া ৯ শতাংশ হয়েছে। এটা আরও কমবে বলে আশা করি।
শাক-সবজি সংরক্ষণে ১০০টি হিমাগার তৈরি করা হবে ॥ মৌসুমি শাক-সবজি সংরক্ষণে সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০০টি হিমাগার তৈরি করা হবে। এ সব হিমাগারে কাঁচামরিচ, টমেটো, গাঁজর, ফুলকপিসহ শীতকালীন সব ধরনের সবজি সংরক্ষণ করা হবে। বাজারে সবজির দাম কমে গেলে এ সব সবজি বাজারে সরবরাহ করা হবে। এতে করে শাক-সবজির দাম সারাবছর ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে ৩০ হাজার টন লবণ দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে ॥ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ওই সরকারে কারণেই দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের বড় সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। আর এ কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। তবে এবার কাঁচা চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেট ও অবৈধ বাণিজ্য করার সুযোগ নেই। আগেই কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ দিয়ে রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে ৩০ হাজার টন বিনা মূল্যের লবণ দিচ্ছে সরকার।