ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জি-২০ সম্মেলন প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ০১:২০, ১২ মার্চ ২০২৩

জি-২০ সম্মেলন প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো-  শিল্পোন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো-  শিল্পোন্নত ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনেতিক ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করা। যার মধ্যে রয়েছে আর্থিক খাত, কর কাঠামো, আন্তর্জাতিক আর্থিক খাতের সংস্কার ইত্যাদি। এ ছাড়াও এই সংন্থা অনানুষ্ঠানিকভাবে আর্থিক সংকটকে বিবেচনায় রেখে ব্রিটেন উড পদ্ধতির রূপান্তর সাধন করে থাকে। এই জি-২০ গ্রুপের সভা বছরে একবার হয়ে থাকে  এবং এই সকল সভার আলোচনার এজেন্ডা থাকে সাধারনত প্রবৃদ্ধির নীতিমালা, আর্থিক পদ্ধতির দুর্বলতা নিরীক্ষণ ও অবৈধ আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়।

এই সংন্থাটির অন্যান্য  সংস্থার মতো কোনো সচিবালয় কিংবা স্টাফ নেই, এর পরিবর্তে এটি একজন চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে যা বাৎসরিকভাবে ২০টি সদস্য দেশের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ঘূর্ণীয়মান অবস্থায় বিচরণ করে থাকে যাকে বলা হয় ট্রইকা চেয়র যেমন- বর্তমান-আগে-পরে যাদের কাজ হলো বাৎসরিক সভার এজেন্ডা নির্ধারণ, বক্তা নিরূপণ, এবং অন্যান্য পরিষেবার সুপারিশকরণ। এ ছাড়াও বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ার সংস্থার সচিবালয় তথা সভাগঠনের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে থাকে যেমন ২০০৯ সালে জি-২০ গ্রুপের চেয়ার করেছিল ইউকে ২০০৫ সালে চীন।
জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে এবার সভাপতিত্ব করছে ভারত। গ্লোবাল সাউথ হিসেবে পরিচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন সংকট তুলে ধরতে চাইছে ভারত। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বিভাজন ভারতকে কঠিন কূটনৈতিক পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। নয়াদিল্লিতে জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণ বড় পর্দায় সম্প্রচার করা হয় এবং বিভেদ ভুলে উন্নয়নশীল বিশ্বের সংকট সমাধানের দিকে নজর দিতে জি-২০ জোটভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘এক গভীর বৈশ্বিক বিভাজনের সময়ে আমরা এ বৈঠকে অংশ নিচ্ছি। আজকে এই কক্ষে যারা উপস্থিত নেই, তাদের প্রতিও আমাদের অনেক দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে। ইংরেজিতে রেকর্ড করা মোদির উদ্বোধনী ভাষণ সম্প্রচার করা হয় যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধের কথা সরাসরি উল্লেখ না করলেও মোদি স্বীকার করেছেন, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবারের সম্মেলনে প্রভাব ফেলবে। গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, সন্ত্রাসবাদ এবং যুদ্ধের মতো ঘটনা দেখেছি।

এতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিশ্বব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। মোদি আরও বলেছেন, ‘যেসব সমস্যা আমরা সম্মিলিতভাবে সমাধান করতে পারব না, সেসব সংকট তৈরিই হতে দেওয়া যাবে না। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বড় ফারাক রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ চীন ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি নিন্দা জানায়নি। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণে ভারতের ওপর চাপ বাড়ছে। ভারত এখন পর্যন্ত চাপ সামলে যাচ্ছে এবং সরাসরি রাশিয়ার নিন্দা থেকে বিরত থাকার কৌশলে অটল রয়েছে।

রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। এ ছাড়া ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা না জানালেও গত বছর রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে মোদি বলেছিলেন, ‘এটা যুদ্ধের সময় নয়।’ এমন পরিস্থিতিতে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে ভারত কিভাবে সম্মেলন সফল করবে, তার দিকে বিশ্বের নজর রয়েছে। ভারতকে এমন বিশেষ কিছু করতে হবে যাতে এই নেতারা যুদ্ধের বিভেদকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখা ভারতকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাতে গেলে খুবই সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে গত সপ্তাহে জি-২০ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন কোনো মতৈক্য ছাড়াই শেষ হয়। ওই সম্মেলনে সমাপনী বিবৃতিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ভাষায়’ নিন্দা জানানো হলে ওই বিবৃতি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় মস্কো এবং বেইজিং।
এবারের জি-২০ সম্মেলনের জন্য ভারতের স্লোগান হলো, ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ।’ ২ ফেব্রুয়ারি অধিবেশনে খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নয়ন সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ এবং মানবিক সহায়তার মতো ইস্যুগুলো আলোচনা হয়েছে। এদিকে মোদির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সম্মেলনে ইউক্রেন যুদ্ধ ছায়া ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। কারণ সম্মেলনের আগেই জি-২০ নেতাদের কেউ কেউ যুদ্ধ নিয়ে কড়া বক্তব্য দিয়েছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা কৌশলবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘অবশ্যই এই যুদ্ধের নিন্দা জানানো উচিত। আমি আশা করি, ভারত তাদের কূটনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে রাশিয়াকে এটা বোঝাতে পারবে যে, এই যুদ্ধ শেষ করতেই হবে।’ 
দিল্লিতে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-টোয়েন্টির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আলোচনায় সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ। এই নিয়ে তীব্র মতবিরোধে দুপক্ষের মধ্যেই হয়েছে উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর এক বছর পর এই সম্মেলনেই প্রথম মুখোমুখি বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরস্পরকে কটাক্ষ করেছেন তারা।

বিবিসি খবর বলছে বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিঙ্কেন মন্তব্য করেছেন, ‘ইউক্রেনে বিনা উস্কানিতে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং অন্যায় যুদ্ধের কারণ বৈঠকে আলোচনা  হয়েছে।’ অপরদিকে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ‘ব্যাকমেইল ও হুমকি’ সৃষ্টির অভিযোগ করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তীব্র মতবিরোধে ব্যাঙ্গালুরুর জি-২০ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনের মতো দিল্লির এই সম্মেলনেও কোনো যৌথ বিবৃতি আসছে না বলে জানিয়েছে আয়োজক দেশ ভারত।

ভারত জানায়, তারা ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে আলোচনা অন্যদিকে ফেরাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন নিয়ে তর্ক স্তিমিত করা যায়নি। বর্তমানে জি- ২০ জোটের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছে ভারত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখা ভারতকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতি একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাতে গেলে খুবই সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর  রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত গোবাল সাউথে (গোবাল সাউথ মূলত আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান, প্রশান্ত মহাসাগরীয দ্বীপপুঞ্জ এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিযার উন্নযনশীল দেশগুলো নিযে গঠিত অঞ্চল) বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে উল্লেখ করেছেন অথচ এই বিষয়টি নিয়ে কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত খাদ্য নিরাপত্তা এবং সার সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য খুবই খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কিছু দেশ মহামারি পরবর্তী ঋণের সঙ্গে লডাই করছে।

তাদের জন্য এই সংঘাত মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা সকলের জন্য খুবই গভীর উদ্বেগের বিষয। এই কারণেই এই বৈঠকে গ্লোবাল সাউথের উদ্বেগের ওপর খুব বেশি ফোকাস রাখা হয়েছিল। বিশ্বে সাতটি শিল্পোন্নত দেশ নিয়ে জি-৭ নামে এবং এই গ্রুপ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের ১৯টি উদিয়মান  অর্থনীতির দেশ নিয়ে গঠিত যার মধ্যে রয়েছে জি-৭ ভুক্ত দেশ ( কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ইউকে, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ) ও আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চায়না, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, টারকি ছাড়াও  রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টসহ ইউরোজোনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। জি-২০ গ্র্রুপে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিত্বে রয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি।

×