ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাবলম্বী ফুলচাষির গল্প

জলি রহমান

প্রকাশিত: ০১:০৭, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

স্বাবলম্বী ফুলচাষির গল্প

জারবেরা ফুলের নিজ বাগানে সাজেদা বেগম

মাত্র তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় সাজেদা বেগমের। গরিব বাবার ছয় মেয়ে থাকায় একটু তাড়াতাড়ি বিয়ে দেন বাবা। জন্ম ও বড় হওয়া সাতক্ষীরা জেলাও হলেও সাজেদা বেগমের সংসার জীবন শুরু ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামে। যৌথ পরিবারে শ্বশুর ও স্বামী একই কাজ করতো। ফুলকে ভালো লাগতো বলে প্রায় যেতেন ফুল বাগানে। তাদের কাজে শখ করে একটু একটু সাহায্য করতে গিয়ে ফুল বাগানে কাজ করা ভালোলাগায় পরিণত হলো।

বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই তার স্বামী বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকায় সাজেদা বেগম ফুলের ব্যবসাটা শুরু করেন দক্ষ হাতেই। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। পাশাপাশি রয়েছে হাঁস-মুরগির খামারও।  
গোলাপ, গ্লাডিওলাস, গাঁধা এবং রজনীগন্ধার ফুল চাষ ছিল আমি যখন এই সংসারে আসি। প্রায় ২২ বছর আগের কথা, তখন মাঠ থেকেই ফুল কিনে নিয়ে যেত। সে সময়ে গদখালীর পাইকারি বাজার ছিল না। প্রথম দিকে মহিলা মানুষের এই কাজ করা বা কোনো মিডিয়ায় প্রচার হওয়াকে অনেকেই ভালোভাবে দেখতো না। পরে আমার কাজ দেখে উপজেলা কৃষি অফিসার উৎসাহ দিয়েছেন।

আমেরিকার একটি সংস্থা নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কৃত করেছে ২০১৫ সালে। ভারতে আমাকে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। এভাবেই বলছিলেন সাজেদা বেগম নিজের সাফল্যের কথা। 
অনার্স (¯œাতক) শেষ বর্ষে পড়া একটি মেয়ে এবং দশম শ্রেণিতে পড়া একটি ছেলে রয়েছে সাজেদা বেগমের। নিজে পড়ালেখা বেশি করতে পারেনি। তাই সন্তানদের নিয়ে রয়েছে অনেক স্বপ্ন। তার সংসারের ব্যয়ভার মেটানোর অন্যতম মাধ্যম ফুল চাষ। করোনায় ফুল বাগান অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় আমফানে হল একেবারে নিঃস্ব হওয়ার মতো অবস্থা। সে সময় তাকে অনেক সহযোগিতা করেছিল আরআরএফ নামক একটি এনজিও। পেয়েছিল স্বল্প সুদে ঋণ। যার মাধ্যমে একটি জারবারার শেড দাঁড় করিয়েছিল। এরপর সেখান থেকে যে লাভ আসে তা থেকে আরও একটি শেড তৈরি করে। বর্তমানে তার তিনটি শেড রয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে আরও একটি শেড। নিজের সোয়া বিঘা জমি থাকলেও চাষ করছেন বর্গা নেওয়াসহ প্রায় তিন বিঘা জমিতে। স্বামী যখন সুস্থ ছিল তখন গোলাপের বাগান ছিল।

এখন গোলাপের বাগান নেই কারণ গোলাপ ফুলের কাঁটায় শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ নষ্ট হয়ে যায়। যেহেতু এখন সাজেদা বেগমকেই বেশি কাজ করতে হয়। বর্তমানে তিনি জারবারা ও লিলিয়ান ফুলের চাষ করছেন। তিন বিঘা জমিতে শুধু জারবারার শেডই করা হয়েছে। তার বাগানে কাজ করে চারজন শ্রমিক যাদের দৈনিক ৫০০ টাকা দিতে হয়। 
সাজেদা বেগম তার বাগান থেকে প্রতিদিন প্রায় কয়েকশ ফুল তোলেন যা পাঠিয়ে দেয় গদখালী বাজারে। তবে এ বাজারে ফুলের চাহিদা কম থাকায় ঢাকার পাইকারি বাজার আগারগাঁও পাঠানো হয় অধিকাংশ ফুল। একটি জারবারা ফুলের দাম পড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা। তবে বেচাকেনায় নানা ধরনের অনিয়মের সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি।

ঢাকায় পাঠানো ফুল থেকে প্রাপ্য দাম পেতে নানা রকম হয়রানির স্বীকার হতে হয়। পাইকারি ক্রেতারা বিক্রি হয়নি আবার কম দামে বিক্রি হয়েছে এরকম কথার জালে তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত করে। এজন্য তিনি অনলাইনে বেচাকেনার একটি প্লাটফর্ম তৈরির বিষয়ে আশা প্রকাশ করেছেন। সেখানে প্রাপ্য মূল্য প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করলেন।     
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে ফুল ঢাকাতে পাঠাতে হলে বিকেলে গাছ থেকে ফুল কাটতে হতো। সারারাত পানিতে ভিজিতে সকালে পাঠানো হতো। বর্তমানে খুব অল্প সময়ে যাতায়াত করা যায় বলে কৃষক-কৃষাণীরা খুব ভোরে ফুল তুলে তা বাজারজাত করণের উদ্দেশ্যে পাঠায়। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষি অফিসার মাসুদ হোসেন পলাশ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘বর্তমানে ৬৩০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। প্রায় ৭ হাজার কৃষক এর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং প্রায় ১ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে জড়িত।

ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই চার মাস বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস এবং বাংলা নববর্ষ ঘিরে  ফুলের উৎপাদন ও বিক্রি হয় বেশি। আশা করছি চলতি মাসে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে। দেশের মোট ফুলের ৭০ শতাংশই উৎপাদিত হয় গদখালীতে। যা থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এছাড়া সারা বাংলাদেশে ফুলের বাজার প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। 
ফুলবাজার আরও সম্প্রসারিত করতে এবার জানুয়ারিতে যশোরে ফুল মেলার আয়োজন করেছিলাম। প্রচুর মানুষ এসছিল সে মেলায়। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার লেনদেন হয় ঝিকরগাছা উপজেলায়। গদখালীতে গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবারা, রজনীগন্ধা, গাঁধাসহ প্রায় ৭১ প্রজাতির ফুল চাষ করা হয়। এরমধ্যে কিছু ফুলের মূল্য বেশ ভাল। জারবারা প্রতি পিছ বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ টাকায়। গ্লাডিওলাস ২২ টাকায় এবং গোলাপ ও রজনিগন্ধা প্রায় ৮ টাকা থেকে ১২ টাকায় বিক্রি হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে চাষাবাদের কাজ শুরু হয়।  

বর্তমান সরকার সহজ শর্তে কৃষকদের ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংক থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যায়। করোনাকালীন প্রণোদনা ঋণ পাওয়া যেত ৪ শতাংশ সুদে। এখানে বিভিন্ন এনজিও রয়েছে যেখানে সুদের হার চড়া তবে তারা ছাড় দিয়ে হলেও ফুলচাষিদের ঋণ দিতে আগ্রহী। আধুনিক প্রযুক্তি ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার ফলে ফুল চাষে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এবার ফুল চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। ফুল এখন নানা কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে রূপচর্চা করা ও প্রসাধনী নির্মাণ ইত্যাদি।  
ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত যশোরের ঝিগরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়ন। গদখালীর পানিসারা গ্রামে ১৯৮৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় ফুল চাষ। বর্তমানে সীমিত পরিসরে রপ্তানিও হয়ে থাকে বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের ২৪টি জেলায় প্রায় ৩,৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। এর মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। বিয়ে, জন্মদিন ও পূজা পার্বণে ফুলের ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। হাল সভ্যতায় ফুলের উপস্থিতি এখন সব শুভ কাজে। বাণিজ্যিকভাবে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন বাড়ায় বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।

×