ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

বিমা খাতে অনিয়ম চলছেই, ১৪ বছরেও ফেরেনি শৃঙ্খলা

জাহিদুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০০:০০, ১১ মে ২০২৫

বিমা খাতে অনিয়ম চলছেই, ১৪ বছরেও ফেরেনি শৃঙ্খলা

.

সময়মতো দাবি পরিশোধ না করা, বছরের পর বছর ভারপ্রাপ্ত সিইও দিয়ে কার্যক্রম চালানো, গ্রাহক প্রিমিয়ামের টাকা আত্মসাৎসহ বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব অনিয়ম দূর করে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১০ সালে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পরও বিমা খাতের শৃঙ্খলা ফেরেনি। এমনকি ৫ আগস্টের পর বিমা খাতে সংস্কারের যে আশা করা হয়েছিল, তাও যেন গুড়েবালি। এক্ষেত্রে শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতাই নয়, খাত সংশ্লিষ্টদেরও মানসিকতা পরিবর্তনের অভাব আছে বলে মনে করছেন বিমা বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, ফারইস্ট, হোমল্যান্ড, প্রগ্রেসিভ, পদ্মা, গোল্ডেন, বায়রাসহ জীবন বিমা খাতের দুই ডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর দাবির টাকা আদায়ে ঘুরছে কয়েক লাখ গ্রাহক। আইডিআরএর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের খসড়া বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত জীবন বিমায় ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৭ লক্ষাধিক গ্রাহকের পাওনা ১২ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ হয়েছে ৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। অপরদিকে ২০২৪ সালে মোট উত্থাপিত দাবির পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৯৬৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যার মধ্যে মাত্র ৮ হাজার ৫৯০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মেয়াদপূর্তির ৬-১০ বছর পরও বিমা দাবির টাকা পায়নি, এমন গ্রাহকের সংখ্যাও লাখের উপরে। এমনই একজন বিমা গ্রাহক চাঁদপুরের উত্তর মতলব থানাধীন পাঁচআনি গ্রামের শাহিনা আক্তার। ২০০৮ সালে সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে ১০ বছর মেয়াদি একটি বিমা করেন। ২০১৮ সালে মেয়াদপূর্তি হলেও গত ৬ বছর ধরে দাবির একটি টাকাও তুলতে পারেনি। ভাড়া বাড়িতে থাকা শাহিনা আক্তারের স্বপ্ন ছিল বিমার টাকা তুলে একটি ঘর বানাবেন। প্রতি মাসে ভাড়া বাবদ সঞ্চিত টাকায় উপার্জনে একটি স্থায়ী উপায় বের করবেন। কিন্তু চাঁদপুর থেকে ঢাকা আসা-যাওয়ায় জুতার তলা ক্ষয়ে তার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। টাকা আদায়ে সানলাইফের প্রধান কার্যালয়ে আসা-যাওয়া করতে গিয়ে উপরন্তু ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। বিমা করাই যেন ‘অভিশাপ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও কম নয়। ২০২৩ সালে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চট্টগ্রাম শাখায় ৯৩ জন গ্রাহককে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা আইডিআরএর কাছে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি। শেষ পর্যন্ত টাকা আদায়ে কোর্টের কাছে বিচার প্রার্থণা করে ভুক্তভোগীরা।
সাম্প্রতিক সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধেও গ্রাহকের ৩৫৩ কোটি টাকা তছরুপের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে আইডিআরএর অনুসন্ধানেও ১৮৭ কোটি টাকা তছরুপের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটিতে এখন পর্যন্ত গ্রাহকের বিমা দাবির টাকা বকেয়া নেই, কিন্তু খাত সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা গ্রাহক প্রিমিয়ামের তছরুপ করা এই অর্থ ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটির জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে।
বিমাবিদদের মতে, ১০ টাকার প্রিমিয়ামের বিপরীতে গ্রাহককে ১০০ টাকার বিমা কভারেজ দিতে হয়। তা ছাড়া গ্রাহককে শুধু প্রিমিয়ামের অর্থই নয়, সঙ্গে মুনাফাও (বোনাস) দিতে হয়। ফলে গ্রাহক প্রিমিয়ামের ৩৫৩ কোটি টাকার বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার কভারেজ দিতে হবে। এর সঙ্গে বোনাস হিসেবে আরো কয়েকশ’ কোটি টাকা যুক্ত হয়ে এই দায় ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে বলে ধারণা খাত সংশ্লিষ্টদের। এ ঘটনায় পরবর্তীতে পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড করে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই প্রশাসক তুলে নিতে স্বয়ং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ জারি হয়।
এদিকে আইনে ৬ মাসের বেশি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ খালি না রাখার বিধান থাকলেও ৪ বছর ধরে সেই আইন লঙ্ঘন করছে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠানটির সিইও পদ শূন্য রয়েছে। এখানে সর্বশেষ সিইওর দায়িত্বে ছিলেন এম এম মনিরুল আলম। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ রাকিবুল করিমকে সিইওর চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু চলতি দায়িত্ব পেলেও সিইওর পূর্ণ দায়িত্ব পেতে যোগ্যতার শর্তে ঘাটতি রয়েছে এই কর্মকর্তার। ফলে হতে পারছেন না পূর্ণাঙ্গ সিইও।
এর পরও গত ৪ বছরে নিয়মিত সিইও নিয়োগে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি গার্ডিয়ানের পরিচালনা পর্ষদ। এই অনিয়মে গত ২৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করে আইডিআরএ। একই সঙ্গে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সিইও নিয়োগে ব্যর্থ হলে ফের ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে বলে সতর্ক করে।
তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই পদক্ষেপকে অপকৌশল বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। চতুর্থ প্রজন্মের এক জীবন বীমা কোম্পানির সিইও বলেন, ৪ বছরের অধিক সময়ে সিইও নিয়োগ না দেওয়া আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। যেখানে নিয়মিত সিইও ৬ মাস না থাকলেই আইডিআরএ প্রশাসক নিয়োগ দেওয়াসহ লাইসেন্স বাতিল করতে পারে, সেখানে তেমন কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। এ ধরনের কর্মকা- নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করতে পারে।
এ বিষয়ে গার্ডিয়ান লাইফের সিইও শেখ রাকিবুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আইডিআরএ আমাদের যে জরিমানা করেছে সে বিষয়ে আমাদের পরিচালনা পর্ষদ একটি রিভিউ আবেদন করেছে। তাই রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত না হলে কিছু বলতে পারছি না। আর পরিচালনা পর্ষদ কেন ৪ বছর ধরে সিইও নিয়োগ দেয়নি, এটা তারাই ভালো বলতে পারবে।
শুধু গার্ডিয়ান লাইফ নয়, দীর্ঘদিন যাবত  সিইও নেই এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আরও রয়েছেÑ  সোনালি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, আকিজ তাকাফুল লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামি লাইফ, যমুনা লাইফ, সান লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, বায়রা লাইফ, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স ও রুপালি ইন্স্যুরেন্স। এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এখনো কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা।  উল্লেখ্য, সোনালি লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং রুপালি ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ একই পরিবারভুক্ত সদস্যদের নিয়ে গঠিত। এ ছাড়া উভয় প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শেয়ারও ওই পরিবারটির হাতে, যা সুস্পষ্ট আইন লঙ্ঘন।
তবে বিমা খাতে নানা অনিয়ম থাকলেও সার্বিকভাবে দুটি বিষয়কে প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জালালুল আজিম। গ্রাহকের অর্থ সময়মতো প্রদান না করা এবং কোম্পানির সংখ্যা অনুপাতে দক্ষ জনবল সংকট। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কোনো কোম্পানি যেন ভবিষ্যতে সমস্যায় না পড়ে এ জন্য পূর্ব থেকেই তার ব্যবস্থাপনা ব্যয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সঙ্গে বিমাকে সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশন ও মাঠ কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দরকার।
অনিয়মের কারণে আইডিআরএ কর্তৃক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আরোপের বিরোধিতা করে জালালুর আজিম বলেন, কোনো কোম্পানিকে জরিমানা করা হলে সে তো গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকা থেকেই জরিমানা দেবে। তাই অনিয়ম হলে ব্যক্তিগতভাবে জরিমানা করা উচিত।  
এদিকে বিমায় অনিয়ম বন্ধে আইডিআরএর ব্যর্থতার নিয়ে বিমাবিদ ড. কাজী মুরতুজা আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ দুটি। আমাদের পরিবর্তন করার আগ্রহ নেই এবং যোগ্যতাও নেই। এটি এককভাবে কারো দায় নয়, বরং ব্যক্তির পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, মন্ত্রণালয় এবং গ্রাহকরাও জড়িত। অনেক সময় জরিমানা দিয়েও তারা আইন মানছে না। সেক্ষেত্রে নামমাত্র জরিমানাটাও একটা কারণ। তাই মানসিকতা পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত বীমা খাতে পরিবর্তন সম্ভব নয়।
একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাসিনা শেখ। তার মতে, বীমা খাতে অনিয়ম দূর করতে না পারার প্রধান কারণ মানসিকতা। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বিমা খাতে অবশ্যই কিছু ভালো কোম্পানি আছে, তবে বেশিরভাগেরই ইনটেনশন ভালো না। তারা গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকাকে দায় মনে না করে ইনকাম মনে করে, মেরে দেওয়ার চেষ্টা করে, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মানুষের ক্লেইমের পাওনা টাকা দিতে চায় না, হয়রানি করে। এদের ইথিক্যাল এবং মোর‌্যাল ডেভেলপমেন্টের দরকার আছে। একইসঙ্গে আইডিআরএকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো তাকেও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
কিন্তু প্রায় দেড় দশকেও বীমা খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিজেদের ব্যর্থতা মানতে নারাজ আইডিআরএ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সোলায়মান এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, অতীতে কি হয়েছে সেটা বলতে পারবো না। তবে বর্তমান কর্তৃপক্ষ আসার পর এসব অনিয়ম তদন্ত করে বের করেছেন। এর পরই মূলত কোম্পানিগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া বিমা কোম্পানিগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে প্রতিদিনই কর্তৃপক্ষ থেকে বিভিন্ন বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ ও সিইওর সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। যাদের বিমা দাবি বকেয়া আছে, প্রয়োজনে তাদের সম্পদ বিক্রি করে দাবি পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
লোকবল সংকট নিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে যেখানে প্রায় ৭-৮ হাজার কর্মী কাজ করে, সেখানে ৮২টি বিমা কোম্পানির কয়েক হাজার শাখা মনিটরিং ও সুপারভাইজিংয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সর্বোচ্চ থেকে সর্বনি¤œ পদ পর্যন্ত একশ’ জনেরও কম আছে। তার পরও কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আইডিআরএর নজরে আসলে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

×