ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

 বদলে যাচ্ছে বঙ্গবাজারের রূপ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩

 বদলে যাচ্ছে বঙ্গবাজারের রূপ

.

বছরের এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত হয়ে যায় রাজধানীর সবচেয়ে পুরনো জনপ্রিয় পাইকারি কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজার। অগ্নিকান্ডে নিজেদের সব হারিয়ে পথে বসেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারলেও টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে পুড়ে যাওয়া মার্কেটের খালি জায়গাতেই শামিয়ানা চৌকি বসিয়ে কোনোরকমে ব্যবসা পরিচালনা করে যাচ্ছেন তারা।

পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারকে আধুনিক রূপদান এবং সেখানে ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বঙ্গবাজারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছেবঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান ১০ তলা বিশিষ্ট ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর বেজমেন্ট ছাড়াও থাকবে মোট আটটি ফ্লোর। .৭৯ একর জায়গার ওপর নির্মিত হতে যাওয়া বহুতল ভবনে থাকবে তিন হাজার ৪২টি দোকান। প্রতিটি দোকানের আয়তন হবে ৮০-১০০ স্কয়ার ফুট। ভবনটিতে থাকবে আটটি লিফট, এর মধ্যে চারটি থাকবে ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য। আর বাকি চারটি কার্গো লিফট থাকবে মালামাল ওঠা-নামানোর জন্য।

ছাড়া থাকছে গাড়ি পার্কিং, খাবারের দোকান, সমিতির অফিস, নিরাপত্তাকর্মী এবং সেখানকার কর্মীদের আবাসন ব্যবস্থা। ভবনটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩৮ কোটি টাকা।

তিনটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ভবন নির্মাণের নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যে নকশা সবচেয়ে ভালো মনে হবে, সেটির আদলেই ভবনটি নির্মাণ করবে ডিএসসিসি। নতুন ভবনে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ লিফট ১১টি সিঁড়ি এবং ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি থাকবে ছয়টি। সবমিলিয়ে নকশা চূড়ান্ত করার পর ভবন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করবে ডিএসসিসি। ধারণা করা হচ্ছে, ১০ তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মাণের ফলে বদলে যাবে বঙ্গবাজারের রূপ, সেই সঙ্গে গতি আসবে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যবসায়।

বঙ্গবাজার মার্কেটটি মূলত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, আদর্শ ইউনিট, মহানগর ইউনিট গুলিস্তান ইউনিট নিয়ে গঠিত ছিল। গত এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মার্কেটগুলো পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়। ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, এনেক্স টাওয়ার, বঙ্গ হোমিও মার্কেট এবং বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের কিছু অংশেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ অগ্নিকা- তিন হাজার ৮৪৫ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে।

প্রতিবেদনে অগ্নিকান্ডে প্রায় ৩০৩ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় বলেও উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী সময়ে পুড়ে যাওয়া মার্কেটের ফাঁকা স্থানে শামিয়ানা ছোট ছোট চৌকি বসিয়ে কোনোমতে ব্যবসা পরিচালনা করছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, সেখানে আগের মতো ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।

অবস্থায় সেখানে ১০ তলাবিশিষ্ট নতুন নামে বহুতলবঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতানভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিল ডিএসসিসি। ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ তলাবিশিষ্ট আধুনিক ভবনে থাকবে বেজমেন্ট গ্রাউন্ড ফ্লোর। গ্রাউন্ড ফ্লোরে মোট ৩৮৪টি, প্রথম তলায় ৩৬৬টি, দ্বিতীয় তলায় ৩৯৭টি, তৃতীয় তলায় ৩৮৭টি, চতুর্থ তলায় ৪০৪টি, পঞ্চম তলায় ৩৮৭টি, ষষ্ঠ তলায় ৪০৪টি সপ্তম তলায় ৩১৩টি দোকান থাকবে। ছাড়া অষ্টম তলায় দোকান মালিক সমিতির অফিস, কর্মচারী নিরাপত্তাকর্মীদের আবাসনের ব্যবস্থা রাখা হবে।

ভবনের পার্কিংয়ে একসঙ্গে প্রায় ১৮৫টি গাড়ি ১১০টি মোটরসাইকেল পার্কিং করা যাবে। ভবনটিতে ২২টি খাবারের দোকান রাখা হবে। সেইসঙ্গে নকশায় আরও ৮১টির বেশি দোকান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি দোকানের আয়তন হবে ৮০-১০০ স্কয়ার ফুট।

বিষয়ে ডিএসসিসির মার্কেট নির্মাণ সেলের প্রকৌশলী তৌহিদ সিরাজ বলেন, ভবন নির্মাণে তিন প্রতিষ্ঠানকে নকশা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যেটি সবচেয়ে ভালো বলে মনে হবে সেই নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হবে। বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান ভবনটির নির্মাণ কাজ বেশ গুরুত্ব সহকারে এগিয়ে চলছে। ডিএসসিসির যতগুলো মার্কেট আছে তার মধ্যে মার্কেট ভবনটি হবে সবচেয়ে আধুনিক।

এদিকে, বঙ্গবাজারের স্থানেবঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতাননামে মার্কেট ভবন নির্মাণের খবর আগেই জেনেছেন সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। বিষয়ে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, ব্যবসার জন্য আধুনিক ভবন তাদের ব্যবসায় সুফল বয়ে আনবে। তবে তাদের দাবি, ভবন নির্মাণের পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাই যেন দোকান বরাদ্দ পান। সেইসঙ্গে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের দোকান বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে যেন ছাড় দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, আদৌ দোকান বরাদ্দ এবং ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না- নিয়ে শঙ্কিত তারা। বর্তমানে তারা চৌকি শামিয়ানা টাঙিয়ে কোনোমতে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অবস্থায় যদি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় তাহলে তাদের সেখান থেকে চলে যেতে হবে। তবে তাদের দাবি, ভবন নির্মাণের সময়ে যেন সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অন্য কোথাও তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে দেওয়া হয়।

বঙ্গবাজারে মাহিম কালেকশন নামের একটি দোকানের মালিক খোরশেদ আলম বলেন, ‘ক্ষতি যা হওয়ার তা আগেই হয়েছে। এখন আর আগের মতো ক্রেতা আসে না, বেচাবিক্রিও তেমন নেই। অবস্থায় শুনছি নতুন করে বহুতল ভবন বানাবে সিটি করপোরেশন। বানালে ভালো, আমরা ব্যবসার ভালো পরিবেশ পাব। উন্নত মার্কেটে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা আসবেন। মার্কেটে আগের মতো ব্যবসা ফিরে আসবে। তবে, মার্কেট নির্মাণের দীর্ঘ সময় আমরা কোথায় ব্যবসা করব, কোথায় যাব; আদৌ সময় ব্যবসা পরিচালনা করতে পারব কি না এসব নিয়ে আমরা শঙ্কিত।

জাহান বস্ত্র বিতানের মালিক রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা যারা এখানকার আদি ব্যবসায়ী তারা সবাই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সব মালামাল পুড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়িকভাবে পথে বসেছি। এখন খোলা আকাশের নিচে কোনোরকম ব্যবসা করে যাচ্ছি। আমরা যারা ক্ষতিগ্রস্ত, মার্কেট নির্মাণ হলে তারাই যেন দোকান বরাদ্দ পায়। ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি, কোথাও পুরনো মার্কেটের স্থানে নতুন মার্কেট নির্মাণ হলে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনেকেই নতুন দোকান বরাদ্দ পান না। বরং বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে দোকান বরাদ্দ নেন। আমাদের ক্ষেত্রে যেন এমনটা না হয়, সেটাই দাবি।

সার্বিক বিষয় নিয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক . আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেটের অগ্নিকান্ডে বিশালতা এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নগর এলাকার সেমিফরমাল মার্কেটগুলোর অগ্নিঝুঁকিসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখা উচিত। এজন্য বিদ্যমান অগ্নিনির্বাপণ আইন, বিল্ডিং কোড ইমারত নির্মাণ বিধিমালা যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক মার্কেটগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, আমার মতে বহুতল ভবন না করে চার-পাঁচতলা ভবন করা যেতে পারে। এতে নির্মাণ খরচ যেমন কমবে, ব্যবসায়ীদের খরচও কমবে। ফলে আগের সহনীয় দামের কাছাকাছি ক্রেতারা কেনাকাটা করতে পারবেন। তাই আমি বলতে চাই, যেহেতু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখানে মার্কেট নির্মাণ করবে, তাই এটাকে বহুতল না করে চার-পাঁচ তলা করা ভালো। সেইসঙ্গে অগ্নিনিরাপত্তাসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

×