
.
ঘুলঘুলির কাছে উড়ে এসে একটা পায়রা বসল। ডুগডুগি বলল, তুমি কে গো?
পায়রা মানুষের মতো গলার স্বর নকল করে বলল, আমি সুখের পায়রা।
ওমা! পায়রা সে তো দেখতেই পাচ্ছি। সে আবার সুখের পায়রা কী? যদি সুখের পায়রা থেকে থাকে তাহলে তো দুঃখের পায়রাও আছে।
ঘুলঘুলির কাছে পায়রাটা বসে বলল, দুঃখের পায়রা আছে কিনা আমি জানি না, তবে আমি সুখের পায়রা, শুধু এটুকু জানি।
ডুগডুগির মতো যারা সুখের পায়রার কথা শুনলো তারা সকলেই খুশি। তাদের খুশির কারণ ঘুলঘুলির কাছে এসে বসেছে যে সুখের পায়রাটাই।
এভাবে রোজ ঘুলঘুলির কাছে এসে বসে সুখের পায়রাটা। দিনে দুবার-তিনবার অথবা আরও কয়েকবার উড়ে এসে বসে। ডুগডুগি যখনই তাকে দেখতে পায় এটা ওটা প্রশ্ন করে।
একদিন বলল, আচ্ছা বন্ধু তুমি নিজেকে সুখের পায়রা বল কেন? তোমার ভেতরে কি দুঃখ কষ্ট কিছু নেই?
পায়রা বলল, একটা দুঃখ আছে। কিন্তু আমি সেই দুঃখ অতিক্রম করে এসেছি, এখন সুখী। পেছনের দুঃখ মনে রেখে তো নিজেকে দুঃখী ভাবার মানে নেই কোনো। অতএব এখন আমি একজন সুখের পায়রাই। তোমাকে আমি আমার পেছনের দিনগুলোর কথা বলতে পারি। শুনে তুমি নিজেই বলবে, আমি যথার্থ সুখের পায়রা কি-না।
ডুগডুগির খুব আগ্রহ পায়রার অতীতের কাহিনী শুনতে। সে বলল, ঠিক আছে, তুমি বল তোমার জীবনের কাহিনী।
সুখের পায়রাটা তার জীবনের গল্প শুলু“করল। আমি ছিলাম রাজ-কর্মচারী কর্তৃক অতি আদরে পোষ্য। আমাকে পরিচর্যার জন্য সর্বদা কয়েকজন ব্যতিব্যস্ত ছিল। যেদিন আমার খেতে ইচ্ছে করত না, তারা আরও কয়েক রকমের খাবার এনে দিত আমার মুখের কাছে। ওইসব খাবার খেয়ে আমাকে সুখের অভিনয় করতে হবে। রাজাকে সুখের খেলা দেখাতে হবে এই ছিল আমার কাজ। বোকা রাজা জানত না যে কাউকে খাঁচার ভেতরে আটকে রাখলে সে সুখের খেলা দেখাতে পারে না, তার সব খেলাই থাকে দুঃখের। আমার সব খেলা দেখানোই ছিল দুঃখের। তবে সেটা রাজার চোখের অন্তরালে। আমার খেলা দেখে রাজা সুখ পেত এবং সুখের খেলাই মনে করত। এজন্য রানীমা, রাজা মাঝে মাঝে খুশিতে আমাকে আদর করে চুমো খেতেন, আমার পরিচর্যা যেন ঠিকমতো হয় এজন্য আমার পরিচর্যার বাজেট আরও বাড়িয়ে দিতেন।
এত সুখের ভেতরেও আমার মনে সুখ নেই। আমি রাজ-পরিবারে বন্দি। এই বন্দিত্ব থেকে বের হয়ে আসার আমার কোনো পথ নেই।
ওই দেশে অনেকদিন ধরেই বিদ্রোহী জনগণ রাজ-পরিবারের শাসনের অবসান চাইছিল। হঠাৎ করে তাদের আন্দোলন খুব চাঙ্গা হয়ে উঠল এবং কিছু বিদ্রোহী জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে দিল। রাজ-কর্মচারী আর সৈন্য-সামন্ত দিশাহারা হয়ে পড়ল। রাজার পতন ঘটলো দ্রুত এবং বিদ্রোহীরা ক্ষমতা দখল করে দেশটিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করল।
স্বাধীনতা শব্দটি শুনে তখন আমার কি যে আনন্দ। আমার চোখ জলে ভিজে গেল। নতুন এই দেশটিতে স্বাধীনতার উৎসবে আমাকে জনগণের সামনে নিয়ে আসা হলো। আমি বুঝতে পারলাম, সবাই বিস্ময়ে আমাকে দেখছে যেন আমাকে স্বাধীন করার জন্য এতগুলো লোকের আপ্রাণ চেষ্টা। আবার আমার চোখ জলে ভিজে গেল। স্বাধীনতার প্রতীকীস্বরূপ তারা আমাকে খাঁচার ভেতরে থেকে বের করে আকাশে উড়িয়ে দিল। এবার তোমরাই বল, আমি নিজেকে সুখের পায়রা বলা যথার্থ কি-না।
পায়রার কথা শুনে ডুগডুগির চোখ জলে ভরে গেল। সে গোপনে চোখের জল মুছে বলল, তবুও তুমি সুখী যে স্বাধীনতা পেয়েছ আর আমি দেখো তোমার মতোই একজন পরাধীন। সারাদিন এই বাসায় কাজ করি, এই প্রাচীর থেকে বের হতে পারি না। কতদিন আমি আমার বাবা, মা, ভাই, বোনকে দেখতে পাই না। ডুগডুগির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, আর মনে মনে বলে, একদিন আমিও যদি এই পায়রাটার মতো সুখের পায়রা হতে পারতাম। ততক্ষণে পায়রাটা আবার মনের সুখে আকাশে উড়ে গেল।
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার