
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য একদিন ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে সেই সরকার। পরে বৈদ্যনাথতলাকেই নামকরণ করা হয় মুজিবনগর হিসেবে। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাজনৈতিক কর্মকা-ে ভরপুর এক জীবন। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তাঁর নিরলস রাজনৈতিক কর্মকা-ে কোন বিরতি ছিল না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মময় জীবনের অন্যতম একটি কর্মকা- ছিল দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭০-এর নির্বাচন।
’৭০-এর নির্বাচনের পর পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের টালবাহানায় ক্ষমতা হস্তান্তর বন্ধ হয়। এর পরের ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক ভাষণ এবং অতঃপর ২৬ মার্চ দেন স্বাধীনতার ঘোষণা। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাঙালীর ওপর চালিয়েছিল বর্বরোচিত নৃশংস গণহত্যা। গণহত্যাকে মোকাবেলা করতে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বন্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে নিদের্শনা দানসহ স্বাধীন দেশের সকল কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের চার মূলনীতির অন্যতম একটি হচ্ছে সরকার। সেটি পূরণকল্পে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গঠন করা হয় মুজিবনগর সরকার। যে সরকারের প্রধান বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনমন্ত্রী করে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। এদিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদন হয়। আওয়ামী লীগের চীফ হুইপ দিনাজপুরের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিলের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সকাল ৯টার দিকে বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। গ্রামবাসীর পাশাপাশি দেশী-বিদেশী শতাধিক সাংবাদিক আসেন। তাদের মধ্যে ছিলেন-ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেস। বহু প্রতীক্ষিত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় বেলা ১১টায়। মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ছোট্ট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
১১ এপ্রিল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এরই পথপরিক্রমায় ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরের দিন দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা এবং সংবাদমাধ্যমে ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের এই সংবাদ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হিসেবে দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের সকল ধরনের সমর্থন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সৈন্যরা শুধু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংই দেয়নি, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও প্রেরণ করেছে। যার ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন এবং পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে পেরেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার সৈন্যরা যখন আত্মসমর্পণ করে, তখনই মুজিবনগর সরকার রাজধানী ঢাকায় এসে নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের সকল দায়িত্ব বুঝে নেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যখন ভারতে নামেন তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারত সরকার লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলে বাংলার জনগণ হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে তাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বরণ করে নেয়। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করেন। যার ফলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুজিবনগর সরকার হচ্ছে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার। ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর দিবসটি বাঙালী জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় গৌরবগাথা দিন। জাতির জন্য এ দিনটি একটি ঐতিহাসিক দিনও বটে। এই কারণেই বাংলাদেশের জনগণ দিবসটিকে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা এবং জাতির চেতনাবোধ জাগ্রতের দিন হিসেবে পালন করে থাকে।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়