বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির কারণে আজ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। যার ফলে জীবনযাত্রার মানেও অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের ফলে মানুষ যেমন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করছে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে নিজেদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গবেষণায় উঠে এসেছে; বর্তমানে শতকরা ৬৪ জন প্রতিদিন গড়ে ৪ ঘণ্টা করে কোন না কোন প্রযুক্তিনির্ভর স্ক্রিনের সামনে সময় ব্যয় করে। তথ্যপ্রযুক্তি হলো তথ্য পরিচালনা ও বিতরণের জন্য কম্পিউটার সিস্টেম, সফটওয়্যার ও নেটওয়ার্কের বিকাশ রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার সংক্রান্ত প্রযুক্তি। বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে, তথ্যের সত্যতা জেনে ওই সকল তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ প্রণালী প্রস্তুত, আধুনিকীকরণ, পরিবহন ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকে বলা হয় তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বা ইনফরমেশন ও টেকনোলজি সংক্ষেপে আইসিটি। পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে আমাদের সামনে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে সেটা ধারণার বাইরে। এক পা-দু’ পা করে আমরা সভ্যতার একেকটি স্তর পার হয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। অন্যদিকে আমাদের অনেকের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে।
সম্প্রতি একটি বেসরকারী টেলিভিশন পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে শতকরা ৮০ ভাগ শিশু ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ইন্টানেট ব্যবহারকারী শিশুদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ ব্যবহার করছে শুধু বিনোদনের জন্য এবং ৩৬ শতাংশ শিশু শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে। তাহলে অনলাইনে শিক্ষামূলক ব্যতীত ৬৪ শতাংশ শিশুর ইন্টারননেট ব্যবহার কি সুস্থ বিনোদনের মধ্যেই থাকছে, না কি খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে সমস্ত শিশু-কিশোররা আসক্ত হয়ে পড়ছে অনলাইন গেমসে, পর্নোগ্রাফি, কিশোর গ্যাং, তথ্যচুরি, ব্ল্যাকমেলিং, অবৈধ হ্যাকিং এবং জঙ্গীবাদ উগ্রবাদে। ২০২০ সালে ডিএসপি সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের এক পরিসংখ্যান তথ্য হতে জানা যায়, ১৮ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ৭%, ১৯-২৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৩৪%, ২৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৩৬%, ৩৬ থেকে ৫৫ বছর নারী-পুরুষের মধ্যে ২০% এবং ৫৫ থেকে বেশি বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে ৩% তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে নানা রকম অপরাধ কর্মকা-ের সঙ্গে জড়াচ্ছে। শিশুরা অনলাইন গেমস যেমন ফ্রি ফায়ার, পাবজি ইত্যাদি গেমসে ব্যস্ত থাকার ফলে শিশুদের বিকাশ সাধনে ব্যাঘাত ঘটে। পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে। বিষয়টি আলোচনায় আসায় কর্তৃপক্ষ এ গেমসগুলো বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ২০ হাজারের বেশি পর্নোগ্রাফি সাইট। বর্তমান সময়ে দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে ২৬০০ জিবিপিএস ব্র্যান্ড উইথের ৫০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে টিকটক, লাইকি, ফ্রি ফায়ার, পাবজি অনলাইন গেমস ইত্যাদিতে। আর এতে করে শিশু-কিশোর পারিবারিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এমনকি পরিবারগুলোতে দেখা যায়, ছেলে এক কক্ষে, মেয়ে আরেক কক্ষে মুঠোফোনে ব্যস্ত। ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করছে তারা। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী আসলে সৌজন্যটুকু করতে তারা অনাগ্রহী। বস্তুত, সে যে মুঠোফোনে কোন্্ জগতে চলে গেছে তার খবর কি অভিভাবকরা, আমরা রাখছি? মূলত শিশুটি দিন দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে পরিবারিক বাঁধন থেকে। সামাজিকভাবেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে আজকের শিশু-কিশোররা ক্রমাগত আসক্ত হয়ে পড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মানসিক রোগে বা ডিপ্রেশনে। ডিপ্রেশনের মাত্রা বেড়ে গেলে পরিবার ভুগছে নানা জটিলতায়। ২০১৯ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইএম এইচ) কর্তৃক এক গবেষণায় জানা যায়, আমাদের দেশে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ চিকিৎসা সেবার বাইরে থাকে। বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করছি বিভিন্ন জায়গায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। ঢাকায় ৫০টি থেকে ৬০টি, খুলনায় ৩টি, যশোরে ১৫-২০টি, ফেনীতে ১০টি, রাজশাহীতে ৮১টি, চট্টগ্রামে ১৬টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। যারা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে ২০% খুন, ২৪% নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ জটিল অপরাধ করে আসছে। এই কিশোর গ্যাং মূলত ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসআপ, মেসেঞ্জারে একক অথবা গ্রুপভিত্তিক অপরাধমূলক কাজগুলো করে থাকে। অপরাধীরা তাদের অপরাধ কাজের বেশিরভাগ এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কেন্দ্র করে সংগঠিত করে। মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত হানার মাধ্যম হিসেবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নিজের সব পরিচয় গোপন রাখতে পারে বলে কাউকে হুমকি দেয়া, মিথ্যা সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়া অথবা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ধারণ করে বিভিন্ন অনলাইন সাইটে ছড়িয়ে দিয়ে ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাকমেল করছে অপরাধীরা। তাছাড়া তথ্য হ্যাকিং সম্পর্কিত ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতাটি বেশি লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রদায়িকতার হিংসা, হানাহানি ও প্রযুক্তির অপব্যহারের মাধ্যমে হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই অপব্যবহার বন্ধে এখনই আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের সচেতন মহল এগিয়ে আসলে, সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমাদের শিশু-কিশোর যুব সমাজ রক্ষা পেতে পারে। অবশ্য কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা শিশুদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধানে কাজ করছে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে তাদের এর খারাপ ও ভাল দিক সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। আবার বিনোদনের জন্যও তাদের কিছুটা সময় দিতে হবে কিন্তু অভিভাবক মা-বাবাকে খেয়াল রাখতে হবে শিশু ভ্রান্ত পথে যাচ্ছে কি না। বিদ্যালয়ে শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তির ভাল-মন্দ দিক তুলে ধরতে হবে। যেহেতু, এখন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর। শিশুদের পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা দেয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠদান হচ্ছে। আইসিটি বিভাগ শিশুদের কনটেন্ট তৈরি করছে। সুতরাং শিক্ষকদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের সঠিক পথে পরিচালিত করার সুযোগ আছে। তাদের কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োজনীয়, শিক্ষণীয় পথে পরিচালিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তির ব্যবহারে অভিভাবকদের সজাগ থাকলে প্রযুক্তির অব্যবহার রোধ করে শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব। শিশুদের প্রচুর সময় দিতে হবে অভিভাবকদের। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকেই একটি নির্দিষ্ট গ-ি রাখা দরকার, যাতে সেই ক্ষতিকর ওয়েবসাইটে কেউ ঢুকতে না পারে। পাশাপাশি ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সব তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীকে সচেতন হতে হবে। সন্তান যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা। দরজা বন্ধ একটা রুম স্থায়ীভাবে সন্তানকে বরাদ্দ দেয়া যাবে না। সন্তানের কাছে প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা, কতটুকু ব্যবহার করা উচিত তার ধারণা দেয়া। প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধ নয় বরং ফেসবুক কী? এটা কী কাজে ব্যবহার করা উচিত তা সন্তানকে বুঝিয়ে দিতে হবে। সর্বোপরি সামাজিক অবক্ষয় থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শিশুকালে সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]