ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

শফিক হাসান

কবিতার রোদ্দুর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১৮ জুন ২০২১

কবিতার রোদ্দুর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

বোধকরি সবচেয়ে বেশি ‘কবিতার ক্লাস’ নিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী; দ্বিমত পোষণ করবেন না অনেকেই। কবিতাকে তিনি যেভাবে লালন করেছেন, যাপন করেছেন কবিতার শরীরে, শিখিয়েছেন কবিতার সঙ্গে কিভাবে সহবাস করতে হয়। এমন কবিতাপ্রেমিক বিরল। ‘বিরল’ এ অর্থে- শেষপর্যন্ত তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কবিতার মানুষ। কবিতার শিক্ষক। ভালো কবিতা অনেকেই লিখতে পারেন কিন্তু কবিতার শিক্ষক হতে পারেন ক’জন! নীরেন্দ্রনাথকে আদব দেখিয়ে ‘রোদ্দুরের কবি’ ডাকতেই পারি। কবিতায় তিনি প্রক্ষেপণ করেছেন রোদ্দুরের আভা। কোনো মানুষের যে ‘বিমূর্ত’ রোদ্দুর হওয়ার ইচ্ছা জাগতে পারে, তিনিই জানিয়েছেন প্রথম! অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় ব্যবসায়ী অনেকেই হতে চায়, অর্থের সঙ্গে নামযশও আরাধ্য। আপাত ‘নিরর্থক’ জীবন কারওরই কাম্য নয়। স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা কিংবা প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে একজন অমলকান্তি কেবল রোদ্দুরই হতে চাইল! অমলকান্তি রোদ্দুর হতে না পেরে শেষপর্যন্ত হয়েছে অন্ধকার ছাপাখানার কর্মী। পেয়েছে কায়ক্লেশের জীবন। অন্যদিকে তার বন্ধুরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও একেকজন কিছু একটা অবশ্যই হয়েছে। স্বপ্নের কাছাকাছি, কতটুকু কী হয়েছে নিজেরাই জানে। তবে পেশাগত জীবন উল্টোমুখী হলেও স্বপ্ন এবং বাস্তবতার বড় কোনো হেরফের হয় না; যদি না সেখানে অমলকান্তির মতো ‘বড় লক্ষ্য’ না থাকে! এমন সরল অথচ ব্যতিক্রম চিত্র যিনি দেখাতে পারেন তিনি যে বড় কবি-চিন্তক তাতে সংশয় থাকার কথা নয়। যে কারণে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে বৃহত্তর বাংলা ভাষাভাষীরা বসিয়েছে কবিতা-গুরুর আসনে। এত সহজ করে, এমন অভয় দিয়ে কে আর কবি বানানোর ‘নিশ্চয়তা’ দেবেন! শৈশবে তার ‘কবিতার ক্লাস’ বইয়ের মূল সংস্করণ পেয়েছি, মুগ্ধ হয়ে পড়েছিও। কিন্তু মূল্য বুঝতে পারিনি বলেই বইটি সংরক্ষণ করতে পারিনি, কবিতার ক্লাসের মনোযোগী শিক্ষার্থীও থাকতে পারিনি বেশিদিন। তার আরেকটা কবিতা তুমুলভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় একটি শিশুর মুখ দিয়ে বলাতে চেয়েছেন- রাজা, তোর কাপড় কোথায়? বস্তুত শাসক শ্রেণীর অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা কিংবা খামখেয়ালিপনার কারণেই অনেক মানুষ আজও অন্ন-বস্ত্রহীন। চলতি পথে চোখ মেলে দিগম্বর শিশুর দেখা পেয়েছিলেন। সেই ভাবনা ও দৃশ্য-তাড়িত হয়েই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কলমে ধরা দিয়েছিল কবিতাটি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪-২০১৮) অনেক পরিচয়ে খ্যাতিমান হলেও তাকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় ‘কবিতার ক্লাস’ বইয়ের লেখক তথা প্রশিক্ষক হিসেবে। বাংলা ভাষাভাষী অনেকেই কবিতা লিখতে চায়, কিন্তু যথার্থ গাইডলাইন নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় তার ‘কবিতার ক্লাস’ পূরণ করেছে দীর্ঘদিনের চাহিদা। লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কিংবা নিতান্ত তরুণ সবার জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য। যে কারণে প্রকাশিত হয়েছে বইটির একের পর এক নতুন সংস্করণ। দুই বাংলায় এর সমকক্ষ অন্য কোনো বই নেই বললেই চলে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে। সেখানে প্রাথমিক পড়াশোনার পাট চুকানোর পর ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫১ সালে যোগ দেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। দীর্ঘ সময় সম্পাদনা করেছেন ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা। কবিতায় পেয়েছেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। সাহিত্যের অন্য অঙ্গনেও ছিল তার দীপ্ত পদচারণা। ছড়া, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গদ্য, গোয়েন্দা-গল্প, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণকাহিনী- সব ধরনের রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্পাদক ও বানান বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তার ছিল বিশেষ খ্যাতি। শৈশব থেকেই ছড়া লিখতেন। ১৯৫৪ সালে, ৩০ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। এরপর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’সহ অনেক কবিতার বই। অর্জন করেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। তার কবিতা পঙ্ক্তি- ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়...’ প্রবাদে রূপ নিয়েছে। কবিতায় দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নিতেন না নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তার প্রায় প্রতিটি কবিতায় নিটোল এবং জীবনস্পর্শী একটা গল্প আছে। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার এটাও একটা কারণ। যাপিত জীবনে যা কিছু দেখতেন, তারই চিত্র ফুটিয়ে তুলতেন কবিতায়। ২৯ জুলাই, ২০১৮ সালে মারা যান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। দেশ পত্রিকায় প্রয়াত বন্ধুর স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছিলেন- ‘আমারও আর দেরি নেই। রমাপদকে বেশি দিন একা থাকতে হবে না।... ও খুব শিগগিরই কথা বলার লোক পেয়ে যাবে।’ বন্ধুকে সঙ্গ দিতে তিনি যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন কে জানত! নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী না থাকলেও কবিতার যে ক্লাস খুলে গেছেন, সেটা নিশ্চয়ই সরগরম থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতার শিশুটির প্রতি তিনি প্রত্যাশা করেন এমন অভিব্যক্তি- ...সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে নির্ভয়ে দাঁড়াক। সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করুক : রাজা, তোর কাপড় কোথায়? স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের কবিতা ‘অমল কান্তি’তেও তিনি দেখিয়ে দেন স্বপ্ন-পরিকল্পনা ও বাস্তবতার ফারাকটুকু। একজন মানুষ কীভাবে স্থানচ্যুত হয় বাস্তবতার কষাঘাতে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাবনায় উঠে আসে- আমাদের মধ্যে যে এখন মাস্টারি করে, অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত, যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, উকিল হলেও তার এমন কিছু ক্ষতি হত না। অথচ, সকলের ইচ্ছে পূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। কবিতায় যিনি ছড়িয়েছেন রোদ্দুরের আলো, তিনি কী অবলীলায় বলে দিতে পারেন কবিতা লেখা কঠিন কোনো কম্মো নয়; সব মানুষকেই তিনি কবি করে তোলার স্বপ্ন দেখেন! অন্যকে কবি করে তোলার জন্য প্রদর্শন করেন ‘গুণ্ডমিপনা’ মানসিকতাও! তার ব্যাখ্যাটা শুনি একটু- আমার বলবার কথাটা এই যে, অল্প একটু চেষ্টা করলে যে-কেউ কবিতা লিখতে পারে। আমার মাসতুতু ভাইয়ের ছোট ছেলেটির কথাই ধরুন। গুণধর ছেলে। টুকলিফাই করেছে, পরীক্ষার হলে বোমা ফাটিয়েছে, গার্ডকে ‘জান খেয়ে নেব’ বলে শাসিয়েছে, উপরন্তু চাঁদা তুলে, মাইক বাজিয়ে সরস্বতী পুজো করে বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে তুষ্ট করেছে, তবু- এতরকম কাণ্ড করেও- স্কুল-ফাইনালের পাঁচিলটা সে টপকাতে পারেনি, তিনবার পরীক্ষা দিয়েছিল। তিনবারই ফেল। এখন সে আমাদের হাটবাজার করে দেয়, হরিণঘাটার ডিপো থেকে দুধ আনে, পঞ্চাশ রকমের ফাইফরমাশ খাটে, এখানে-ওখানে ভুল-ইংরেজীতে চাকরির দরখাস্ত পাঠায় এবং- এবং কবিতা লেখে। তা সে-ও যদি কবি হতে পারে, তবে আপনি পারবেন না কেন? বাস্তবিকই কবিতা যদি এত সহজ হত! কথায় বলে, কচু গাছ কাটতে কেউ কেউ খুনি হয়ে ওঠে! তেমনি ‘ভুলভাল’ কবিতা লিখতে লিখতেই একজন নিশ্চয়ই একদিন কবি হয়ে উঠবেন। তাকে মগডালে তুলে দেওয়ার জন্য নীরেন বাবুর এমন অভয়বাণী ভীষণ জরুরী! [email protected]
×