ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

বায়ুদূষণে ৭০ লাখ মানুষের প্রাণনাশ

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বায়ুদূষণে ৭০ লাখ মানুষের প্রাণনাশ

সারাবিশ্বে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে গ্যাসীয় আবরণ পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে তাকে বায়ুম-ল বলে। পৃথিবী মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে বায়ুম-লের ও ভূপৃষ্ঠের চারদিকে জড়িয়ে থেকে অনবরত আবর্তন করছে। বায়ুম-লের বর্ণ, গন্ধ, আকার কিছুই নেই। একে শুধু অনুভব করা যায়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে ১০০০ কিমি পর্যন্ত বায়ুম-ল বিস্তৃত। কিন্তু বায়ুম-লের ৯৭ ভাগ উপাদানই ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০ কিমির মধ্যে সীমাবদ্ধ। বায়ুদূষণ বলতে বোঝায়, বায়ুতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থের কণা এবং ক্ষুদ্র অনু অধিক পরিমাণে বায়ুতে মিশে যায়। তখন এটি বিভিন্ন রোগ, এ্যালার্জি এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ ছাড়াও এটা অন্যান্য জীবন্ত বস্তু যেমন পশু-পাখি ফসল ইত্যাদির ক্ষতি করে। দূষিত বায়ু পরিবেশের জন্য বাধা। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সালে বায়ুদূষণে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। প্রাকৃতিকভাবে অথবা মানুষের কর্মকা-ের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকর ও বিষাক্ত পদার্থের দ্বারা বায়ুম-লের দূষণ হয়। বায়ুদূষণের পূর্ণ কোন একটি এলাকায় বায়ুতে অবমুক্ত ক্ষতিকর ধোঁয়া, শিল্পকারখানার কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া। বায়ুদূষণের আরও একটি কারণ এ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের উর্ধ বায়ুম-ল পশু-পাখি এবং জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর এসিড বৃষ্টি সংঘটনের মাধ্যমেও বায়ুদূষণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে আসছে। ভারতের রাজধানী দিল্লী বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরগুলোর মধ্যে একটি। এ ছাড়া কলকাতা, দিল্লী সংলগ্ন এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ক্ষিপ্র গতিতে নগরায়নের ফলে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে। শীর্ষে রয়েছে দিল্লী। ঢাকার পরেই রয়েছে করাচী ও বেজিং। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ু দূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত এবং বাংলাদেশে। আর এই দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেডিকম ইভালিউশন-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন বলছে, বায়ুতে যে সব ক্ষতিকর উপাদান আছে তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএস ২.৫। এতদিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত হতো চীনে। গত ২ বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে জাপানের টোকিও শহর। প্রতিবেদনটিতে মূলত কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলা হয়েছে। আর বায়ুদূষণের কারণে শিশু মৃত্যুর হার পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। পিএস ২.২৫ ছাড়াও বায়ুর অন্যান্য দূষণকারী পদার্থের উপস্থিতির দিক থেকে সামাজিক দূষণের একটি চিত্র এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। তাতে শীর্ষ বায়ু দূষণকারী দেশ হিসেবে চীন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বসনিয়া ও পাকিস্তানের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ও বায়ু দূষণবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক আব্দুস ছালাম ১০ বছর ধরে ঢাকা ও বাংলাদেশের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁর হিসাব অনুযায়ী, মূলত যান্ত্রিক উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া ও ধুলা থেকে বাতাসে ক্ষুদ্রকণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। মূলত কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাঁটি, শিল্প-কারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মানসামগ্রী থেকে তৈরি ধূলায় এগুলো সৃষ্টি হয়। গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে বিশ্বে যে সব কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় তার মধ্যে বায়ুদূষণ রয়েছে পঞ্চম স্থানে। ২০১৫ সালে প্রায় ৪২ লাখ মানুষের অকালমৃত্যুর কারণ এই বায়ুদূষণ। আর এসব অকালমৃত্যুর অর্ধেকের বেশি ঘটেছে ভারত ও চীনে। এসব দেশে প্রতি ১০ জনে ১ জন দূষণমুক্ত বায়ু এলাকায় বসবাসের সুযোগ পায়। বায়ুদূষণের কারণে ২০১৫ সালে চীনে বছরে ১১ লাখ ৮ হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ভুক্ত দেশগুলোয় এ সংখ্যা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৪০০। গত বছরে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদেনে বলা হয়, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য এবং নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দারা বায়ুদূষণের প্রধান শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে পিএম ২.৫-এর নিারপদ কিংবা সহনীয় মাত্রা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা যায়নি। দূষিতবায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ ও হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায়। পিএম ২.৫ এর কারণে এজমা ও ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। শিল্প, যানবাহন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ন বায়ু দূষণের কয়েকটি প্রধান কারণ। নানা কারণে বায়ুদূষণ ঘটে, যার অর্ধেকটা মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। বায়ুদূষণকারী পদার্থ : কার্বন মনোক্সাইড : পেট্রল, ডিজেল এবং কাঠসহ নানা ধরনের কার্বণযুক্ত জ্বালানি, আধপোড়া হলে এই রংবিহীন, গন্ধবিহীন গ্যাসটি তৈরি হয়। সিগারেট পোড়ালে এই গ্যাস বের হয় এবং সবসময় ঝিমানো ভাব আসে। বিভিন্ন ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতারও শিকার হতে হয়। কার্বন ডাই অক্সাইড : মানুষের নানা কর্মকা-ের ফলে নির্গত প্রধান গ্রীন হাউস গ্যাস। কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ফলে নির্গত হয়। লেড বা সীসা : এই পদার্থটি লেড বা ব্যাটারি, পেট্রল, ডিজেল, হেয়ার ডাই, রং প্রভৃতি পণ্যে পাওয়া যায়। সীসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের ক্ষতি করে থাকে। এটির প্রভাবে হজমের প্রক্রিয়া ও ¯œায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে ক্যান্সারও হতে পারে। সাসপেনডেড পার্টিকুলার ম্যাটার : ধোঁয়া, ধুলা, বাষ্প এবং একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে বাতাসের ভেসে থাকা কঠিন পদার্থের কণাকে এসপিএম বলে। এটি বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বা নীতিমালা প্রণয়ন ও জনসচেতনতামূলক কর্যক্রমের মাধ্যমে নির্মল বায়ু ও পরিবেশের টেকসই উন্নয়নকল্পে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ শীর্ষক এ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। বায়ুদূষণের মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত কল-কারখানার ধোঁয়া এবং দ্বিতীয়ত যানবাহনের ধোঁয়া। সার-কারখানা, চিনি, কাগজ, পাট, কাপড় তৈরির মিল, চা তৈরির ফ্যাক্টরি, ট্যানারিজ বা চামড়ার কারখানা, গার্মেন্টস, রসায়ন ওষুধ শিল্প থেকে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয়! যাতে থাকে নানা রকম ক্ষতিকারক উপাদান, ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, অধিকহারে যানবাহন বৃদ্ধি বায়ু দূষণে ভূমিকা রাখছে। বেবিট্যাক্সি, টেম্পো, মোটরসাইকেল, ট্রলি প্রভৃতি টু-স্ট্রোক যানবাহন থেকে অধিক ধোঁয়া নির্গত হয়। বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ যানবাহন ত্রুটিপূর্ণ, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সম্প্রতি সরকার ২০ বছরের অধিক পুরনো যানবাহন রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তারপরও ঢাকার রাস্তায় চলছে পুরোনো এবং ত্রুটিযুক্ত ইঞ্জিনের গাড়ী। বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচার কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি ঘি : রাতে শুতে যাওয়ার আগে এবং প্রতিদিন সকালে নাসারন্ধ্রে দুই ফোঁটা ঘি ফেলবেন। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ২-৩ চামচ ঘি খেলে বায়ুদূষণের কারণে শরীরের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। হলুদ : প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ১ চামচ হলুদের গুঁড়ার সঙ্গে ১ চামচ র্ঘি বা মধু মিশিয়ে খাওয়া শুরু করুন। তা হলে দেখবেন বায়ুদূষণ আপনার টিকিও ছুঁতে পারবে না। ডালিমের রস : প্রতিদিন সকালে না হয় বিকেলে ১ গ্লাস করে ডালিমের রস খাওয়া শুরু করুন। এই প্রাকৃতিক উপাদানটি রক্তকে পরিশুদ্ধ করার পাশাপাশি হার্ট এবং ফুসফুসকে সুস্থ রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তুলসী পাতা: বাড়ির বাহিরে তুলসী গাছ লাগানো আছে তো! না থাকলে আজই লাগান। কারণ একাধিক গবেষণায় এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, বায়ুদূষণের প্রভাব কমাতে তুলসী গাছ দারুণভাবে সাহায্য করে থাকে। আসলে তুলসী পাতা বাতাসে উপস্থিত ক্ষতিকর উপাদানকে শোষণ করে ফেলে। ফলে বাতাসে বিষের পরিমাণ কমতে শুরু করে। প্রতিদিন যদি ১০-১৫ মিলিলিটার নির্যাস করে তুলসী পাতার রস খাওয়া যায়, তাহলে আমাদের শরীরের ওপর বায়ুদূষণের যে কুপ্রভাব পড়ে, তা কমতে শুরু করে। নিম : পানিতে নিমপাতা ফুটিয়ে সেই পানি দিয়ে সপ্তাহে কয়েকবার গা ও মাথা পরিষ্কার করলে শরীরের বহিরাংশে পরিবেশ দূষণের খারাপ প্রভাব কমতে শুরু করে। বায়ুদূষণরোধে করণীয় -বাড়ি, কারখানা, গাড়ি থেকে ধোঁয়া নিঃসরণ কম করার চেষ্টা করুন। -আতশবাজি ব্যবহার করবেন না। -জঞ্জাল ডাস্টবিনে ফেলুন, পোড়াবেন না। -থুথু ফেলার জন্য আলাদা জায়গা বা সব সময় জল দিয়ে ধুয়ে দেয়া যায়, এমন জায়গা ব্যবহার করুন। -সবাইকে বায়ুদূষণ সংক্রান্ত আইন মেনে চলার কথা বলুন। রাসায়নিক দূষণ রোধ করুন রাসায়নিক সারের বদলে জৈবসার ব্যবহার করুন। পলিথিনের বদলে কাগজ ব্যবহার করুন। পলিস্টারের বদলে সুতি ও পাট ব্যবহার করুন। -ঠিকভাবে পলিথিনের ব্যাগ নষ্ট করার ব্যবস্থা করুন। -আরও গাছ এবং উদ্ভিদ লাগান। লেখক : গবেষক
×