ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সত্যরঞ্জন সরকার

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৮ আগস্ট ২০১৮

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ

১৯৭১ সাল, রক্তারুণ দিগ¦লয়ে কাঁপছে উদয় ঊষার নব সূর্যরেখা। বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গে যে নবজন্মের আর্তি, তার দিগন্ত প্রকম্পিত শব্দমালা ‘জয় বাংলা’ সেদিন ছিল বাঙালীর কণ্ঠে কণ্ঠে। শিশুঘাতী, নারীঘাতী, পাকসৈন্য ও এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের বর্বরতার প্রতিরোধে এমন সম্মিলিত সংগ্রামের ইতিহাসে নিজের বুকের রক্তে বাঙালীরাই একমাত্র লিখেছে। অহিংস গণ-অসহযোগ থেকে স্বতন্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, সংসদীয় গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতার রক্তলাল পতাকা উত্তোলন, বিশ শতকের বিশ্ব রাজনীতিতে এমন ঘটনা অকল্পনীয়, অভাবনীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। উনিশ শতকের জাতীয়তাবাদী চিন্তায় তিনি বিশ শতকের প্রাগ্রসর মুক্তচিন্তার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের যোগ ঘটিয়েছিলেন। ১৯৭১ থেকে বিশ বছর আগে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায় শেখ মুজিব ছিলেন ফরিদপুরের তথা গোপালগঞ্জের অজ গ্রাম থেকে আগত একজন যুবনেতা। অচিরেই তিনি সারা বিশ্বের সচমক বিস্ময় ও শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টির সামনে বাঙালী জাতির জনকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। সত্তর দশকের ইতিহাস তার জন্য এমন এক ঈর্ষাযোগ্য আসন সংরক্ষিত করে রেখেছিল, যা ষাট দশকেও তিনি নিশ্চয়ই জানতেন না। আর এ কথাও হয়ত জানতেন না, ইতিহাস নিজের প্রয়োজনে তার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে উত্তাল সংগ্রামের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। তিনি হবেন আন্দোলনের নেতা, সংগ্রামের নেতা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। এদিক থেকে তিনি ইতিহাসের মানসপুত্র। ইতিহাস তাঁকে তৈরি করেছে। তাই তাঁর নেতৃত্বে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান। কেউ ইতিহাসে একটি পঙক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউবা এক একটি অধ্যায়, কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব হচ্ছেন সমগ্র ইতিহাস। সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তার জন্ম। ধ্বংস, বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলিমাটিকে তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনার ভিত শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখ-কে শুধূু তাদের মানসে নয়, অস্তিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয় নেতার মতো এই ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ এবং দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। এখানেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা। বাংলাদেশের দেহে রক্ত ঝরেছে অনেক। কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু, হারানো সম্ভ্রম বিশ্ব বিবেককে বিদীর্ণ করেছিল। এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশা বিচলিত করেছিল প্রত্যয়ী শান্তিবাদীদেরও। তবে একটা জাতির রূপান্তর ও নবজন্মের বিদীর্ণ বেদনাও সেখানে আজ অশ্রুত নয়। প্রতিরোধ থেকে প্রত্যাঘাতের চেতনা এমন মূর্ত ঐক্যের বিরাট বিশাল বিস্তার স্বজন হারানো বেদনাকে স্বদেশের প্রতি পবিত্র ও নিখাদ ভালবাসায় পরিণত করেছিল। বাংলার ইতিহাসে শেখ মুজিবের আত্যন্তিক মূল্য এইখানে যে, তিনি এই হারানো স্বদেশিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা তথা পুনর্জন্মের প্রতীক। স্বদেশিকতায় এই শক্তির কোনদিন পরাজয় ঘটে না । বাঙালীর আত্মপ্রতিষ্ঠার লোকায়ত শিল্প, সংস্কৃতি ও সভ্যতা হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার কালো ধোঁয়ায় তার এই লোকায়ত সংস্কৃতি, স্বদেশ ও স্বজনকে বাঙালী বহু যুগের জন্য বিস্মৃত হয়েছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনের আঘাতে সে বিস্মরণের ঘোর কেটেছে চব্বিশ বছরে ধীরে ধীরে। এই কুয়াশা মুক্তির ইতিহাস নতুন বাংলার ইতিহাস । মুজিবের বাংলার ইতিহাস। নিজের জীবদ্দশাতেই কেউ কেউ অত্যাশ্চর্যভাবে নিজ ব্যক্তিত্বের গুণে কোন দেশ বা তার ইতিহাসের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। যেমন ভারতের মহাত্মা গান্ধী, মিসরের নাসের, ভিয়েতনামের হো-চি-মিন, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, চীনের মাও সেতুং, রাশিয়ার লেনিন, প্যালেস্টাইনের ইয়াসির আরাফাত এবং আরও কেউ কেউ। বাংলাদেশের মুজিবও তাই। এ কেমন করে সম্ভব? একজন ব্যক্তির মধ্যে ইতিহাসের পুনর্জন্ম বা নবজন্ম কি সম্ভব? নাকি ইতিহাসের প্রয়োজনে এই একজন ব্যক্তির জন্ম? গান্ধীর ভারত, না ভারতের গান্ধী? মুজিবের বাংলা, না বাংলার মুজিব? এই প্রশ্নেরও জবাব রয়েছে ইতিহাসে। ইতিহাসে ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বের ধাত্রীদেবতা সেই ব্যক্তিই আবার ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোজনা করেন। ইতিহাসকে এগিয়ে দেন নতুন পথের বাঁকে। সুতরাং যে ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের ¯্রষ্টা ইতিহাস তাঁকে সৃষ্টি করেছে। ইতিহাস থেকে তাঁর জন্ম। স্বয়ম্ভু ব্যক্তিত্বের কোন ঐতিহাসিকতা নেই ইতিহাসে। তা তিনি যতই পা-িত্য ও খ্যাতির অধিকারী হোন না কেন। আবার অনেক অখ্যাত ও অজ্ঞাতজনকে ইতিহাস তার নিজের প্রয়োজনে রূপকথার হাতির শুঁড় হয়ে তুলে নিয়েছে খ্যাতি ও সমারোহের মঞ্চে। কেবল ইতিহাসের প্রয়োজন পূরণ করে পথের রাখাল হয়েছেন কালের রাখাল রাজা। আগেই বলেছি, ব্যক্তি কখনও ইতিহাসের একটি বা একাধিক পঙক্তি,পৃষ্ঠা বা অধ্যায় হয়ে ওঠেন, কখনও গোটা ইতিহাস হয়ে ওঠেন না। যে বা যিনি জাতির উত্থানে-পতনে, সুখে-দুঃখে মিশে গিয়ে নিজের সুখ, দুঃখ, উত্থান-পতন জীবন ও মৃত্যুকে এই ইতিহাসের ধারায় সমর্পিত করেন, ইতিহাসের অতীতে ও বর্তমানের ঐতিহ্যে বিস্তৃত হন, আবহমান ইতিহাসের ¯্রােতকে সংগ্রাম ও সাধনার অধঃপাত থেকে উর্ধমুখী করার চেষ্টা করেন, তিনিই ইতিহাসের মানসপুত্র। তিনিই গোটা ইতিহাসের প্রতিভূ, জাতির ¯্রষ্টা, জাতির জনক। দাদাভাই নওরোজী, নেতাজী সুভাষ বোস, গোখলে, মাওলানা আজাদ ভারতের ইতিহাসের খ- খ- অধ্যায়; কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সমগ্র ইতিহাস। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, জেনারেল ওসমানীÑ এরা বাংলাদেশের খ-িত অধ্যায়। সমগ্র ইতিহাস বিনির্মাণে এদের প্রত্যেকের অবদান থাকলেও ‘মুজিব’ সমগ্র ইতিহাস। বাংলাদেশের কয়েক শতাব্দীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জাগরণের স্বপ্ন চরিতার্থতা খুঁজেছে শেখ মুজিবের মধ্যে। তাই মুজিব আজ বাংলার ইতিহাস। কাপুরুষোচিত বর্বর হত্যাকা-ের মাধ্যমে তাঁকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার শত ষড়যন্ত্র শেষেও এ কথা ধ্রুব সত্য ‘মুজিবের বাংলাদেশ-বাংলাদেশের মুজিব’। গান্ধীজীর ‘ভারত ছাড়ো’ বা ‘কুইট ইন্ডিয়ার’ সময় নেতাজীর সক্রিয় সমর্থন তৎকালীন রাজনীতিতে সোনায় সোহাগার মতো ক্রিয়াশীল ছিল। সেই রাজনীতির যুগে শেখ মুজিব অতি তরুণ রাজনীতিবিদ। মুজিব মানসে গান্ধীবাদ ও সুভাষবাদের দ্বন্দ্বও অতি স্পষ্ট। নিজের রাজনৈতিক সংগঠন তৈরির ক্ষেত্রে মুজিব সুভাষবাদী; কিন্তু এই সংগঠনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আন্দোলন পরিচালনাকালে মুজিব গান্ধীবাদী। দৃশ্যত মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের সুভাষ; কিন্তু তাঁর রাজনীতিতে গান্ধীবাদের প্রভাব অনেক বেশি স্পষ্ট। ১৯৪২ সালে গান্ধী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে সুভাষ বোস ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করার জন্য নিজে দেশ ত্যাগ করেছেন এবং ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দু’জনেরই আন্দোলনের লক্ষ্য এক; কিন্তু কার্যধারা ছিল পৃথক অথচ সমান্তরাল। পরস্পরের সঙ্গে তারা যুক্ত হননি কোনদিন। গান্ধীজী আন্দোলনের পরে জেল থেকে বেরিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের আলোচনায় বসেছেন। অথচ সুভাষ বোস জাপানের সহযোগিতায় ভারতের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধারণের অভিযোগ মাথায় নিয়ে রাজনৈতিক জীবন, এমনকি ইহজীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। বিস্ময়ের কথা, শেখ মুজিব ’৬৭ ও ’৬৮ সালে ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধরার চক্রান্তের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তিনি সুযোগ পেয়েও দেশত্যাগ করেননি, বরং গান্ধীজীর মতো মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেও তিনি কারাবরণ করেছিলেন। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তি চরিত্রে ও আদর্শে মুজিব অসহযোগী হয়েও কারাবরণ করেছেন, দেশত্যাগ করেননি। কিন্তু তাঁর রাজনীতিতে সুভাষবাদী পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগকে বৈপ্লবিক মুক্তিযুদ্ধের পতাকা বহনে বাধ্য করেছিল। শেখ মুজিব ছিলেন একজন সাধারণ বাঙালী নেতা। কিন্তু এই সাধারণ মানুষটি সেদিন অসাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে সারাবিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছিলেন। একবাক্যে সেদিন সারাবিশ্ব মুজিবকে চিনত। বাংলাদেশের বাউল গায়ক থেকে লন্ডন, নিউইয়র্কের বিটল গায়কের কণ্ঠে সেদিন যে গান বেজেছিল তা ছিল মুজিবের বাংলার গান। মুজিব সেদিন বাংলার ইতিহাসই ছিলেন না, ছিলেন বাংলার মানচিত্র। বাংলাদেশ থেকে মুজিবকে কিংবা মুজিব থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করে ভাবা আজও অসম্ভব। আর এ অসম্ভবকে সম্ভবে রূপদানের ধৃষ্টতা বাঙালীরা কোনদিন মেনে নেবে না। বৃটিশ শাসিত ভারত আর পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবীদের দ্বারা শাসিত বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য ছিল এটুকু যে, ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বৃটিশ জাতি উন্নত ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। অন্যপক্ষে বিংশ শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের পশ্চিমা পাঞ্জাবীরা ছিল অনুন্নত রুচি ও চিন্তার অধিকারী এবং তারা বল প্রয়োগে শাসনের ফ্যাসিবাদী নীতিতে আস্থাশীল। শাসক হিসেবে গান্ধীজী যাদের সম্মুখীন হয়েছিলেন বা যে রাজনৈতিক শাসন কাঠামোর মধ্যে তিনি তার অসহযোগ আন্দোলনের চরিত্র বিনির্মাণ করেছিলেন, পশ্চিমা পাঞ্জাবী শাসিত ও সমর্থিত বাংলাদেশে মুজিব তা কখনও পাননি। শাসক হিসেবে মুজিব যাদের পেয়েছিলেন তারা নীতিজ্ঞানবর্জিত, নিকৃষ্ট, সামরিক আমলা, অত্যাচারী এবং তাদের রাজনৈতিক শাসন কাঠামো ষোড়শ শতকের ডাচ ও পর্তুগীজ উপনিবেশের প্যাটার্নের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মধ্যে পুলিশের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন দমনের জন্য কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান ও কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলীর নির্দেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত পাকিস্তানের পাঞ্জাবী সেনাপতি (জিওসি) আইয়ুব খান তার সেনাবাহিনীকে পবিত্র রমজান মাসের পহেলা তারিখে বিক্ষুব্ধ পুলিশের ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। [রক্তাক্ত বাংলা-১৯৭৩ সালে প্রকাশিত মুক্তধারার প্রবন্ধ সঙ্কলন]। ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে ঢাকার যে ঐতিহাসিক ‘লালবাগ বিদ্রোহের’ সৃষ্টি এবং দেশীয় সিপাইদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনায় সেই লালবাগ আবারও নিরস্ত্র পুলিশের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। জিন্নাহ পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে গবর্নর জেনারেল পদে মনোনীত হওয়ার পর তিনি পার্লামেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে বৃটিশ প্রবর্তিত ভারত শাসন আইনের ঔপনিবেশিক চরিত্রের সুযোগ গ্রহণপূর্বক নিজেকে রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান থেকে স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্তায় রূপান্তরিত এবং ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পার্লামেন্টে এবং রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু অংশ বাঙালীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে ঘোষণা করেন ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার এই অসহিষ্ণু ও উদ্ধত মনোভাব বাঙালীরা কখনও মেনে নিতে পারেনি। তাই সৃষ্টি হয় ’৫২’র ভাষা আন্দোলন, যা শুধু বাঙালীর কাছেই নয়, সেই ভাষা দিবস ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ পরিণত হয়েছে। সে অন্য ইতিহাস। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করার পর বাংলাদেশের শহরে, বন্দরে, প্রতিটি প্রধান রাজপথে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তন এবং ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে ঢাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিরস্ত্র ছাত্র শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের অনেককেই আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তারিখে শেখ মুজিবের মুক্তি ও ছয় দফা দাবি দিবসে আবারও হত্যাকা-ের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেদিনের সেসব হত্যাকা-ের পর গণরোষ এবং গণআন্দোলনের নেতৃত্ব সঠিকভাবে দিতে হয়েছিল শেখ মুজিবকে। সেদিন তথাকথিত স্বাধীনতার কল্পিত ঘোষকদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। ভাবতে কষ্ট হয়, এই ইতিহাস অনেকে জানলেও আজ তাদের ভাগ্যের উন্নয়নের প্রয়োজনে মিথ্যাকে সত্যাশ্রয়ী করে প্রচারনায় নিজেরা যেমন মত্ত, তেমনি জাতিকেও এই সব জ্ঞানপাপী অন্ধকারের কালো গুহার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে তৎকালীন ছয় দফার একটু বিশ্লেষণ যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করি। সেদিনের ছয় দফাতে কি ছিল? আজকের নবপ্রজন্মের অনেকে হয়ত তা জানে না। ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতায় এসব আজ প্রায় মুছে যেতে বসেছে। অতএব নবপ্রজন্মকে এসব ইতিহাস আজ জানতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব অজানা থেকে যাবে। শেখ মুজিবের ছয় দফা, যা বাংলার ‘ ম্যাগনাকার্টা ’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল, তা নিশ্চয়ই কোন সামরিক ব্যক্তির মগজ থেকে বেরিয়ে আসেনি। এটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের চরম ও পরম চাওয়া-পাওয়ার ইতিহাস। সংক্ষেপে ছয় দফার সারকথা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রথম দফা : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ‘শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে। পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়তে হবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভার সার্বভৌমত্ব বজায় থাকবে। দ্বিতীয় দফা : ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার- এই দুটি বিষয় থাকবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় প্রাদেশিক পরিষদের হাতে থাকবে। তৃতীয় দফা : ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক দুটি সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন থাকবে। এই ব্যবস্থানুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুই পৃথক স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন এক সুনির্দিষ্ট বিধান থাকবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেশন রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে; দুই অঞ্চলের দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। উপরোক্ত দু’টি প্রস্তাবের যে কোন একটি গ্রহণের জন্যই প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। চতুর্থ দফা : সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে সরাসরি জমা হবে। এভাবে জমাকৃত অর্থই ফেডারেশন সরকারের তহবিল হবে। পঞ্চম দফা : এই দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ক) দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখতে হবে। খ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে। গ) ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্র নির্ধারিত মতে আদায় হবে। ঘ) দেশীয় উৎপাদিত পণ্য বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি ও রফতানি চলবে। ঙ) ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশে চুক্তি সম্পাদনের বিদেশ ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি ও রফতানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করে শাসনতান্ত্রিক বিধান করতে হবে। ছয় দফা : এই দফায় পূর্ব পাকিস্তানের মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি গঠনের সুপারিশ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানকে আগে বাঁচিয়ে সুযোগ থাকলে পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানো হবে, এটা কোন যুক্তি হতে পারে না। ১৯৬৫ সালের ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধে প্রমাণ করেছিল শত্রুর দয়া ও মর্জির ওপর আমাদের বাঁচতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের জন্যই ছিল। সংক্ষেপে ছয় দফার মূল বক্তব্য ছিল এরকমই। ছয় দফা আন্দোলন বেগবান লাভ করে আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলাকে সামনে এনে বাঙালীরা সেদিন কিভাবে ফুঁসে উঠেছিল তার দৃষ্টান্ত মেলে তৎকালীন পত্র-পত্রিকায়। ভারতের গান্ধীজীর জীবিতাবস্থায় অসহযোগের যে পূর্ণ প্রয়োগ ঘটেনি তা ঘটেছে শেখ মুজিবের বাংলাদেশে। বাঙালীর একমাত্র সেøাগান ছিল সেদিন ‘জয় বাংলা’। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি, প্রশাসন ব্যবস্থার ছোট-বড় সকল কর্মকতা, এমনকি সুদূর গ্রামাঞ্চলের পর্ণকুটিরের একজন দিনমজুর পর্যন্ত শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর, ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হবেই’- এই অমোঘ বাণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে বাঙালীরা সেদিন তাঁর উদাত্ত আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এক মুজিব থেকে সেদিন লাখো মুজিবের কণ্ঠধ্বনি ভেসে এসেছিল। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সেদিন খ--বিখ-, শ্রেণী শত্রুতায় নয়, সে ছিল পরিপূর্ণ শ্রেণী ঐক্য, জাতীয় ঐক্য, যা সেদিন পরিলক্ষিত হয়েছিল। সেই ঐক্যের ভিত্তি ছিল (১) ধর্মনিরপেক্ষতা (২) বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব। তৎকালীন জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু এবং জাতীয় জীবনের প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই জাতীয় ঐক্যের অমোঘ বর্ম তৈরি করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ইতিহাসে তাঁর নেতৃত্বের এখানেই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। শোষক ও শাসক শক্তি তাঁর যে প্রাণ হননের চেষ্টায় সেদিনও ব্যস্ত ছিল, স্বাধীনতার পরেও তারা তা থেকে বিচ্যুত হয়নি। তবে বাইরের ও ভিতরের শত আঘাতে মুজিব সেদিন নিজে বিচ্যুত হননি তাঁর লক্ষ্য থেকে। সেই লক্ষ্য ছিল বাংলার তথা বাঙালীর মুক্তি, বাংলার হারানো অধিকারের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু হায়! ১৯৭৫ সালে ঘাতকেরা তাঁকেসহ তাঁর পরিবার-পরিজনকে নির্মমভাবে হত্যার পর শেখ মুজিবকে যারা বাংলার ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে দিতে চেয়েছিল তারাই আজ ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দিয়ে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ভেসে গিয়েছে। শেখ মুজিব শুধু বাংলার নবরূপকারই ছিলেন না, তিনি গোটা দক্ষিণÑপূর্ব এশিয়ার রক্তাক্ত যুগসন্ধিক্ষণের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। ভবিষ্যতের মূল্যায়নে যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রবহমান থাকবে ততদিন বাঙালী মনে রাখবে তাদের এই শতাব্দীর মহানায়ককে; যিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলার জন্য, বাঙালীর জন্য। পরিশেষে কবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে গেয়ে যাই- ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ। মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান॥’ লেখক : কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিশেষজ্ঞ
×