ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

বেহাল প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ১৫ মার্চ ২০২২

বেহাল প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা

করোনার চরম দাপটে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব গত ২ বছর এক সঙ্কটকাল পার করে। স্থবিরতার জালে অবরুদ্ধ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকের জট খুলতেও ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করতে হয়। সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থার শিকার হয় জাতির মেরুদ- শিক্ষা কার্যক্রম। আমাদের বাংলাদেশে সেই ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। সবার আগে বিবেচনায় আসে দেশের খুদে ও উদীয়মান প্রজন্মের স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধি। তাদের জীবন নিয়ে অনেক বেশি ভাবতে হয়েছে সরকারকে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় করোনার প্রভাবে যে চরম দুঃসময় দেখা দেয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসার যথার্থ পথনির্দেশনা পেতে যথেষ্ট সময় লাগে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর থেকে কিছুটা স্থবিরতা কাটানো সম্ভব হলেও প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার দ্বার কোনভাবেই খোলা সম্ভব হয়নি। তার ওপর খুদে শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রমে সেভাবে সম্পৃক্ত না হওয়ার অসহনীয় দৃশ্য সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। শিক্ষাজীবনের নতুন পথ উন্মোচন করার সন্ধিক্ষণেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুর্ভোগ পোহানো যেন এক করুণ আখ্যান। ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। ক্রমান্বয়ে উচ্চশিক্ষার পাদপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহও নতুন করে প্রাণ চাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ হওয়াও সময়ের অপরিহার্য দাবি। এরই ধারাবাহিকতায় বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া (মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক) যেন শিক্ষা পাঠক্রমের গতিশীলতার অনন্য পর্যায়। যদিও তা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। উচ্চশিক্ষায় দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের অনুপ্রবেশে মেধা ও মনন যাচাই করা হয়। শিক্ষা তার প্রাতিষ্ঠানিক এবং স্বাভাবিক গতি ফিরে পেলেও সময়ক্ষেপণের দাম কত দিতে হবে সেটা এখনও অজানাই। প্রযুক্তির বিশ্বে পাঠদান কার্যক্রম কতখানি সফল হয়েছে সে প্রশ্নের যৌক্তিক সমাধান এখন অবধি হয়নি। শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালকদের অভিমতও খুব বেশি স্বস্তিদায়ক হয়নি। তবে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের নিয়ে বাগবিত-ায় না জড়িয়ে বরং কোথায় তাদের সার্বিক মঙ্গল তেমনটি বিবেচনায় প্রাধান্য পেতে সময় লাগেনি। তবে প্রাক প্রাথমিকের যে দুর্ভোগ সেটা আলোর মুখ দেখতে অনেক বেশি সময় ব্যয় করাও উদ্ভূত পরিস্থিতির অনাকাক্সিক্ষত পর্যায়। শেষ অবধি প্রাক প্রাথমিকের দ্বার উন্মোচনে কোন্ পরিস্থিতি সামলাতে হবে বলা মুশকিল। দীর্ঘ ২ বছর যে অভ্যস্ত শ্রেণী পাঠ থেকে তারা দূরে সরে ছিল পুনরায় সেখানে ফিরে আসাটা কতখানি অনুকূল হবে সেটাও ভাবার বিষয়। ইতোমধ্যে প্রাক প্রাইমারীর অনেক শিক্ষার্থী মূল কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ার চিত্রও দুঃখজনক। এমনিতে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রতিবছর শিক্ষার্থীর পাঠক্রম থেকে বিচ্যুত হওয়ার দৃশ্য হতাশাব্যঞ্জক। করোনার মহাবিপদকালীন ঘরে বসে অলস সময় নষ্ট করা নিত্যদিনের এক অসহনীয় দুর্ভোগ। এমনিতে কিছু সরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রাইমারী শিক্ষার আগে প্রাক প্রাথমিক কার্যক্রম চালু হবার চিত্র উঠেও আসে। যদিও সংখ্যায় তা অত্যন্ত কম। সিংহভাগ প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যক্তি মালিকানাধীন বেসরকারীভাবে প্রচলন করা হয়। সেটা শুধু বিভাগীয় শহর কিংবা জেলায় নয়, গ্রামেগঞ্জে ইউনিয়ন পর্যায়েও এই প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাকে যে মাত্রায় অবারিত করা হয়েছিল সেখানে গ্রামগঞ্জের ছোট ছোট শিশুরা লেখাপড়ায় সম্পৃক্ত হতে অনেক সুযোগও পেয়ে যেত। আবার সদ্য স্নাতক করা তরুণ-তরুণীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে। করোনার অযাচিত সংক্রমণে সবকিছুর ওপরই রুদ্ধতার জাল বিস্তৃত হলে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রমই গতিহীনতার আবর্তে পড়ে বেশি। বেসরকারী প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোন ভবনের মধ্যে তাদের পাঠদান শুরু করে। গত দুই বছরে সেসব ভবনের দুরবস্থা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নের রড, সিমেন্ট, বালি, ইট রাখা ছাড়াও গরু-ছাগলের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ার দুঃসহ দৃশ্যও বেদনাদায়ক। শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারই নয়, তা সর্বজনীন হওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অনেকটা দিবা শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের মতো। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় তাদের প্রতি নজরদারি করাও অত্যন্ত সহজ। খেলাধুলা, সবার সঙ্গে মিলেমিশে লেখাপড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ হওয়া কোমলমতি শিশুদের জন্য যেন আনন্দযজ্ঞের মহানিমন্ত্রণ। শিশুদের শিক্ষারম্ভ ব্যাপারটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও এমন জটপাকানো অবস্থায় সেখানে কোমলমতি খুদে প্রজন্ম শিক্ষাকে ধারণ করার বিপরীতে কণ্ঠস্থ করতে বেশি মনোযোগী হয়। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রাক প্রাইমারী বিদ্যানিকেতনে শিশুদের আনন্দযোগ পাঠক্রম অবারিত করাও আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতিদিনের শিক্ষা যদি মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে না পারে তাহলে তা হবে খ-িত এবং অংশত। নতুন করে প্রাক প্রাথমিক পাঠক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবারিত করাও অবশ্যই সময়ের অপরিহার্য চাহিদা, কোমলমতি শিশুদের নতুনভাবে পাঠক্রমে মনোনিবেশ করানোও অন্যতম দায়বদ্ধতা। খুদে অনেক শিক্ষার্থী যেমন ঝরে পড়ার আবর্তে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা একইভাবে শিক্ষকদের চাকরি হারানোও এক অনভিপ্রেত ঘটনাপঞ্জি। এটা স্পষ্ট যে, সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। আরম্ভটা কতখনি নির্বিঘœ আর নিঃসংশয় হবে সময়ই তা বলবে। তবে ইতোমধ্যে নতুন বছরের প্রায় আড়াই মাস গত হতে চলল। হাতে আছে মাত্র সাড়ে ৯ মাস। এরই মধ্যে নতুন পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সিলেবাস সম্পন্ন করা, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়া সবই যেন নিরাপদে চলতে পারে সেদিকেও কঠোর নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। গোটা দুই বছরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকর্মযোগের ক্রমাগত বিরতি কতখানি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে সেটাও বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়। অবশ্য উপস্থিত সঙ্কট মোকাবেলার বিভিন্ন ধরনের যৌক্তিক নির্দেশনাও সামনে চলে আসে। সেভাবেই খুদে শিশুদের আবশ্যিক পাঠক্রমে মনোযোগী হতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের তীক্ষè পর্যবেক্ষণও জরুরী। তবে আমাদের দেশের শিশুরা এখনও টিকা কার্যক্রমের আওতায় আসতে পারেনি। নতুন ওমিক্রন ভাইরাসে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার চিত্রও বিচলিত করে। ফলে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সবার আগে আমলে নেয়াও পরিস্থিতির অনিবার্য চাহিদা। শুধু তাই নয়, পরিত্যক্ত প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনকেও জীবাণুনাশক ওষুধে বিশুদ্ধকরণও সবার আগে জরুরী। বাংলাদেশ করোনার দুঃসহ সংক্রমণ থেকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় এসেছে। করোনা এখনও একেবারেই নির্মূল হয়নি। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিম্নগামী হলেও স্বাস্থ্য বিধিমালাকে অবহেলা কিংবা উপেক্ষা করা মোটেও সমীচীন হবে না। বিধিগুলো যেমন পরিবার থেকে শুরু করা প্রয়োজন, পাশাপাশি তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষাও নিতান্ত জরুরী। মাস্ক অবশ্যই প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে সন্নিবেশিত হওয়া অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একইভাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজের সঙ্গে রাখাই আবশ্যক। প্রাক প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও সচেতন সাবধানতায় কোমলমতি শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো সর্বাধিক আমলে নেয়া সময়ের চাহিদা। এখানে কোন গাফিলতি কিংবা বিধিবহির্ভূত কার্যক্রম অনুমোদনের অযোগ্য বিবেচিত হবে। জাতির খুদে প্রজন্ম তাদের নতুন শিক্ষা পাঠক্রমে সম্পৃক্ত হতে যাচ্ছে। এর চাইতে ভাল খবর অন্য কিছু নয়। দীর্ঘ ২ বছরের অপেক্ষার পালা যেন শেষ। তবে দুই বছরের আগে যারা প্রাক প্রাথমিকে ছিল তারা এখন অবশ্যই প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। সুতরাং তাদের নতুন আর এক যাত্রা এখন অন্য আলোকিত জগতে। একেবারে নতুনভাবে আসা শিক্ষার্থীদের আসলে হারানোর কিছু এখনও হয়নি। তারা নবোদ্যোমে নতুন আশার আলোকিত নিজেদের যাত্রাপথ অবারিত করবে সেটা দেশ ও জাতি কামনা করে। করোনার মহাসঙ্কট মানুষের দৈনন্দিন পথযাত্রায় যে দুর্যোগের ঘনঘটা বর্ষণ করে সেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়াও পরম আশ্বস্তের বিষয়। তবে নতুন করে আর কোন করোনা বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়ানো থেকে এবার ক্ষান্ত হোক এমন প্রত্যাশা পৃথিবীর সব মানুষের। সুস্থ জীবনের চিরস্থায়ী বার্তায় সবাই উদ্বুদ্ধ হোক, এক বাসযোগ্য নিরাময় পৃথিবীর সব মানুষের জন্য অবারিত ধারায় এগিয়ে যাবে এটাই এখন সর্বজনীন এক প্রত্যাশা। আর জাতির খুদে প্রজন্মের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হোক নতুন ও আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার মহাপ্রত্যয়ে। লেখক : সাংবাদিক
×