ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১

​​​​​​​গরমে দুই শিক্ষকের মৃত্যু

ঢাকা রাজশাহীসহ পাঁচ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

​​​​​​​স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪; আপডেট: ১১:১৩, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

ঢাকা রাজশাহীসহ পাঁচ জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

.

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকাসহ দেশের পাঁচটি জেলার সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সোমবার বন্ধ থাকবে। বাকি চারটি জেলা হলো- চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী।

রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, দেশে চলমান দাবদাহের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী জেলার সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ সোমবার বন্ধ থাকবে। তবে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ চাইলে খোলা রাখতে পারবে। এ ছাড়া পরবর্তী সময়ে এ পাঁচ জেলায় কিংবা তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, এমন অন্যান্য জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত সোমবার জানিয়ে দেওয়া হবে।

তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই সারাদেশে স্কুল খোলার দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্কুলে একাধিক শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শ্রেণিকক্ষে কোনো শিক্ষার্থী করেছে বমি, কেউ আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। পরিস্থিতি বুঝে এসব শিক্ষার্থীদের বাড়ি পাঠিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এদিন হিটস্ট্রোকে চট্টগ্রাম ও যশোরে মারা গেছেন দুই শিক্ষকও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রচ- গরমে মাধ্যমিকের ক্লাস রুটিন পরিবর্তন জরুরি ছিল। যেটা প্রাথমিকে করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেটি না করে শনিবারের ছুটি বাতিল করেছে।

দীর্ঘ ছুটির পর রবিবার সকাল বেলায় রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখা যায়। ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ ছাতা নিয়ে এসেছেন কেউ বা টুপি পরে। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকেই এসব ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষার্থীদের অসুস্থতার খবর পাওয়া যায়। গরমের কারণে এদিন অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে স্কুলেও পাঠাননি। হিট এলার্টের মধ্যে স্কুল খোলায় অধিকাংশ অভিভাবক অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, অন্তত এক সপ্তাহ অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমতো।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ জানায়, সকালের শিফটে মূল শাখায় ১৫০৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল না এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী। আজিমপুর শাখায় অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী এদিন ক্লাসে যোগ দেয়নি। বসুন্ধরা শাখায় ১৫৩৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল ৪৮৯ জন। তবে ধানমন্ডি শাখায় ৮০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। রাজধানী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ফারহানা খানম জানান, সকালের শিফটে কোন শিক্ষার্থীর অসুস্থতার ঘটনা ঘটেনি। এমন গরমে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম। এ ছাড়াও সব ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ক্লাস টেস্ট চলমান থাকলে অসুস্থ শরীর নিয়েও বাচ্চারা স্কুলে আসবে। যে কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া। অভিভাবকদের দাবি এদিন অন্তত তিন শিক্ষার্থী গরমের কারণে অসুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছে।

অন্যদিক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষার্থী তাপপ্রবাহের প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে স্কুলেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি ভার্সনের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ক্লাস শেষ হতেই বমি শুরু করে। আইডিয়ালের অনেক শিক্ষার্থী গরমের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন। উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা বলেন, এই গরমের মধ্যে স্কুলে পাঠদান বন্ধ করে অনলাইনে ক্লাস নিলে ভালো হয়। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রকোনুজ্জামান সেখ জানান, মর্নিং শিফটে ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। ডে শিফটে এটি কমে ৬০ এ নেমে এসেছে। স্কুলে নার্স, পানি, স্যালাইনসহ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। রবিবার তাপপ্রবাহের কারণে একাধিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক এসে ছুটির আবেদন করে বাচ্চাদের নিয়ে গেছে। এদিন স্কুলে উপস্থিতি ছিল মাত্র ৬০ শতাংশ। শিক্ষকরা জানান, শুধু শিক্ষার্থী নয়, প্রচ- গরমে শিক্ষকদের ক্লাস নিতেও অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে।

তীব্র তাপপ্রবাহে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বন্ধ রেখে অন লাইনে শ্রেণির কার্যক্রম তথা পাঠদানের ব্যবস্থা করার দাবি আবারও তুলেছে অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরাম। সংগঠনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু জানান, সারাদেশের  তীব্র তাপপ্রবাহের তেমন কোনো উন্নতি না হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাকে সমীচীন মনে করছি না। ছোট  ছোট শিক্ষার্থীরা তীব্র তাপ প্রবাহ চলমান থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহে সরকারি সিদ্ধান্তে দেশের কোথাও যদি কোনো শিক্ষার্থীর কোনো রকম জীবন বিপন্ন ঘটে বা কোনো রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার সব ধরনের দায়ভার সরকার ও সংশ্লিষ্ট স্কুল কর্তৃপক্ষে বহন করতে হবে।

স্টাফ রিপোর্টার যশোর থেকে জানান, যশোরে স্কুলে যাওয়ার পথে গরমে অসুস্থ হয়ে আহসান হাবীব নামের এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। তিনি সদর উপজেলার আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হাবিবুর রহমান ওই শিক্ষকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। স্কুলশিক্ষকের বাবা ইউসুফ আলী মোল্লা জানান, আহসান হাবীব সকালে রোদের মধ্যে মাঠে ধান কাটছিলেন। পরে ধান কেটে বাড়িতে ফিরে আহসান হাবীব অসুস্থ বোধ করেন। বাড়ির লোকজন তার মাথা, হাত ও মুখে পানি দেয়। এরপর তিনি স্কুলে যাওয়ার সময় আরও তীব্র অসুস্থ বোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। শিক্ষকের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আহসান হাবীব বিগত দশ বছর ধরে স্কুলে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। তার একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে।

সংবাদদাতা, বোয়ালখালী চট্টগ্রাম জানান, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী কালুরঘাট  ফেরিতে হিট স্ট্রোকে প্রাণ হারিয়েছেন মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী (৫৫) নামের এক মাদ্রাসা শিক্ষক। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন। রবিবার সকালে মাদ্রাসা খোলায় তিনি নগরীর চান্দগাঁও মোহরা এলাকার বাসা থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশে আসছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৯টার দিকে কালুরঘাটের পশ্চিম পাড় থেকে পায়ে হেঁটে ফেরিতে উঠেন ওই শিক্ষক। এরপর হঠাৎ ফেরিতে ঢলে পড়েন তিনি। তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেছেন। মাওলানা মো. মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া লেমশীখালীর মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে। তার ২ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে।

জানতে চাইলে মাদ্রাসা অধিদপ্তদের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) জাকির হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, সারাদেশে ৮ হাজার ২০০ এর বেশি মাদ্রাসা রয়েছে। আমরা সব সময় এসব মাদ্রাসা মনিটরিং করে থাকি। তবে এদিন বড় কোন ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। এই মাদ্রাসার শিক্ষক কওমি মাদ্রাসা না এমপিওভুক্ত সে বিষয়ে খবর নেওয়া হচ্ছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জানিয়েছেন, তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি বা তার বেশি হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের স্কুল স্থানীয় প্রশাসন বন্ধ করতে পারবে। তাপমাত্রা সব জেলায় সমান নয়। যেমন, চট্টগ্রামে তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেখানে স্কুল বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। রবিবার সকালে আগারগাঁও ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠার শেষে  এসব কথা বলেন তিনি।

গত জানুয়ারিতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রা ছিল এমন ১০ জেলায় স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। যেখানে যেখানে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল সেখানে স্কুল খোলা ছিল। এখন গরমের সময়ও একই পদ্ধতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি চালু করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কিছু হলেই প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে, এ ধারণা রাখা চলবে না। আমাদের নতুন কারিকুলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক; তাই শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে আসা জরুরি। শনিবার স্কুল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠলে আবারও মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।

সারাদেশে আবারও হিট এলার্ট জারি করা হয়েছে। এ সময় বাইরে বের হলে শারীরিক ক্ষতি হবে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মেনে চলতে বলা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি। আবহাওয়া সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাপমাত্রার পারদ চড়তে থাকে। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল শুরু হয় ৮-১০টার দিকে। চলে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত। তাপমাত্রা নির্ধারণ করে স্কুল কখন বন্ধ ঘোষণা করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

×