ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাড়ে তিন হাত জমি

প্রকাশিত: ২০:৪২, ১২ মে ২০২১

সাড়ে তিন হাত জমি

মানুষ সৃষ্টির সেরা। তাই তার কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তাও হওয়া চাই সেরা ও বিবেচনাপ্রসূত। জীবনকে সে যেমন উপভোগ করবে, তেমনি অর্থবহও করে তোলা চাই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বেশিরভাগ মানুষই জীবন সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবেন না। এমনকি করোনার মতো মহামারীকালেও মানুষকে তার জীবনের অর্থ সম্পর্কে গভীর বোধ তৈরিতে অসমর্থ হয়। একজন মানুষের মৃত্যু যে কোন মুহূর্তেই হতে পারে। আর কি উপায়ে হবে সেটিও আগেভাগে বলার উপায় নেই। তবু মানুষ মনে করে চিরকালই যেন সে বেঁচে থাকবে। অন্তত আশি-নব্বই-এক শ’ পর্যন্ত তো জীবন উপভোগ করা চলবে। তাই তার চাই চাই চাই। এই চাওয়া আর সবকিছু কুক্ষিগত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থেকে সে কি সুখের নাগাল পায়? নাকি তার বেঁচে থাকা আরও দুর্বিষহ ও কষ্টকর হয়ে ওঠে? শেষ পর্যন্ত একজন মানুষের আশ্রয় কিন্তু সাড়ে তিন হাত জমি। সেখানেই তাকে অন্তিম বা চিরশয্যা পাততে হয়। অথচ সে জীবনভর ব্যস্ত থাকে একের পর এক জমি দখলে। সৎপথে ক্রয় করে হোক, কিংবা ছলে বলে কৌশলে জবরদস্তি করে হোক। এমন বাস্তবতা থেকেই মানুষ হয়ে ওঠে ভূমিখেকো বা জমিখেকো। অথচ জীবনের উপসংহারে তার প্রয়োজন মাত্র সাড়ে তিন হাত জমি। ঢাকার নতুন শহর প্রকল্প পূর্বাচলের প্লট বিতরণকালে প্রধানমন্ত্রীর গভীর জীবনবোধ থেকে উচ্চারিত বক্তব্যে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিশাল বিশাল অট্টালিকা থাকলেও নতুন গড়ে ওঠা পূর্বাচলে একটি প্লটের জন্য অনেকের মরিয়া ভাবের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, যাদের এত বিশাল বিশাল অট্টালিকা, বাড়িঘর, ফ্ল্যাট সবই আছে তাদের আরও লাগবে কেন? মরলে তো সবাইকে যেতে হবে সেই কবরে- মাত্র সাড়ে তিন হাত জায়গায়। এই ধনসম্পদ কেউ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। এই কথাটা মানুষ কেন ভুলে যায় জানি না। তাই অতিরিক্ত সম্পদ গড়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। এই ঢাকা শহরেই বহু মানুষ ভাসমান, গৃহহীন। বহুসংখ্যক মানুষ অন্যের বাড়িতে উচ্চমূল্যে ভাড়া থাকেন। এই দুর্মূল্যের বাজারে ঢাকা তো নয়ই, অন্য কোন শহরেও একখ- জমি কেনার সামর্থ্য অনেকেরই হবে না কোনদিন। তাই এক অর্থে তারাও জমিহীন। যদিও অনেকেরই দেশের বাড়িতে নামমাত্র হলেও থাকে একচিলতে ভিটেমাটি। আবার নদীভাঙ্গনের এই দেশে বহু মানুষরেই জমি ও ঘরবাড়ি ভেসে যায়। সামগ্রিকভাবে যদি আমরা আমাদের দেশের মানুষের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব হাজার হাজার মানুষের মাথা গোঁজার মতো নিজস্ব কোন জমি নেই। আবার এমনও হাজার হাজার মানুষ আছে সমাজে যাদের ঢাকা শহরেই রয়েছে একাধিক বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট। গুলশান-বনানী-বারিধারার মতো অভিজাত অঞ্চলে জায়গাজমি থাকার পরেও যারা মহানগরীতে নতুন কোন আবাসিক প্রকল্প গড়ে ওঠার পরিকল্পনার খবর জানতে পেরে সেখানেও একটি প্লট পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, তাদের আসলে ক্ষুধা বিপুল। এই ক্ষুধা যেন কোনকালেই মেটার নয়। কিন্তু মানুষ তো সমাজবদ্ধ জীব, সমাজেই তারা যূথবদ্ধভাবে বসবাস করে। তাই আশপাশের মানুষের জীবনের দিকেও তার বা তাদের তাকানো জরুরী। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যেন আমরা চারপাশের মানুষকে নিয়েই সম্মিলিতভাবে ভাল থাকি। এই করোনাকালে চারপাশে মানুষের দুর্দশা দেখেও যাদের বিবেক জাগ্রত হয় না তারা কি আসলে মানুষ!
×