ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুকুমার বিশ্বাস

মুক্তিযুদ্ধ এবং তার প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ এবং তার প্রেক্ষাপট

১৯৭১ সালে আমি নবম শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স চৌদ্দ বছর। মানসিক অবস্থার বিকাশ ঘটলেও শারীরিক বৃদ্ধি তেমনটি ঘটেনি। আমি সবুজ শ্যামল শীতল ছায়াঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের ছেলে। কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত, টেলিফোন, সংবাদপত্র কিছুই নেই। শুধু দু’একটি রেডিও আছে। আমাদের অঞ্চলের দু’একজন পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ঢাকা শহরে ছোটখাটো চাকরি করেন। তারা রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাদের আলোচনায় আন্দোলনের তীব্রতার আভাস পেলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লাখ লাখ জনতার সমাবেশে রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকণ্ঠে দেশের স¦াধীনতার ঘোষণা দিলেন এবং যার যা আছে তাই নিয়ে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিলেন। শ্রীরামকাঠী ইউ. জে. কে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমার শিক্ষাগুরু, সুসাহিত্যিক মনীন্দ্রনাথ বড়াল মহোদয় তার বাসভবনের সম্মুখের আঙিনায় খুবই চিন্তামগ্ন অবস্থায় বসে আছেন। আমি সবুজ ঘাসের ওপর বসে আছি। মাঝখানে গোল টুলের ওপর রাখা আছে একটি ফিলিপস্ কো¤পানির রেডিও। কিছুক্ষণ পরে শুরু হবে আকাশবাণী কলকাতা এবং বিবিসি কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা খবর যার অধিকাংশ খবর এদেশের আন্দোলন আর মুক্তিসংগ্রাম বিষয়ক। মনীন্দ্রনাথ বড়াল ‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ’ স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়নের জন্য স্কুল মাঠে জনসভার আয়োজন করলেন। সভায় তৎকালীন পিরোজপুর নাজিরপুর অঞ্চলের সংসদ সদস্য এবং অন্যান্য সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হলেন। দু’একটি দলের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি চোখে পড়ল না। সংগ্রামী জনতার উপস্থিতিতে স্কুল মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হলো। নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্র এবং এ অঞ্চলের যুবকদের সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। বাঁশের লাঠি রাইফেলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে জনাব মতি কমান্ডার স্কুুল মাঠে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করলেন। তিনি শিখালেন কি করে রাইফেল চালাতে হয়, বিমান হামলা হলে কি করে বাংকারে আত্মরক্ষা করতে হয়, যুদ্ধক্ষেত্রে কোন যোদ্ধা আহত হলে তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে কিভাবে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় ইত্যাদি বিষয় প্রশিক্ষণ। জীবনের এ প্রান্তে এসে আমাদের প্রশিক্ষক জনাব মতি কমান্ডার সাহেবকে জানাই হাজার সেলুট। ’৭১-এর এপ্রিল মাসের বিশ একুশ তারিখ হবে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমরা আমাদের বড় খালের ফেদুরাম ব্রিজের ওপর অনেকে দাঁড়িয়ে পূর্ব-দক্ষিণ কোনে দেখলাম আগুনের লাল লেলিহান শিখা। জানা গেল পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা ঝালকাঠী শহরে ব্যবসায়ীদের তেলের গুদামে আগুন দিয়েছে। ঝালকাঠী এ অঞ্চলের বড় পাইকারি ব্যবসা কেন্দ্র। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠন করে ধ্বংস করে দেয়া হলো। নিরীহ অনেক ব্যবসায়ী এবং তাদের আত্মীয় পরিজন হত্যা করল, কিছু লোককে বেঁধে নিয়ে গেল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ক্যাম্পে। তারা আর ফিরে আসেনি কোনদিন। আমি আমার জন্ম ভিটা শ্রীরামকাঠী গ্রামে ঘটে যাওয়া পৈচাশিক মৃত্যু, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের ঘটনা অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে এ লেখায় বর্ণনা করছি যা আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার বাড়ির পাশেই ঐতিহ্যবাহী শ্রীরামকাঠী ইউ জে কে উচ্চ বিদ্যালয়, কালীগঙ্গা নদীর তীরে শ্রীরামকাঠী বন্দর। রবিবার এবং বুধবার সাপ্তাহিক হাট বসে। হাজার হাজার লোকের সমাগম। শত শত নৌকা নিয়ে দূর-দূরান্ত হতে মানুষজন কেনাবেচা করতে আসে বন্দরে। এ অঞ্চলটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাস অধিক সংখ্যায়। হাটের দিন বন্দরে এসে ভিড়ল পাক মিলিটারীর লঞ্চ, সঙ্গে তাদের দোসর রাজাকার বাহিনী। আর এলো লুটেরাবাহিনী বড় বড় নৌকা নিয়ে। মানুষ ছুটাছুটি শুরু করল, গুলিও শুরু হলো। বহু ব্যবসায়ী এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা লোকজন গুলিতে মারা গেল। অগ্নিসংযোগ করল, লুটকারীরা সর্বস্ব লুট করে নৌকা বোঝাই করে উল্লাস করতে করতে চলে গেল। পাকবাহিনী কিছু যুবককে দড়িতে বেঁধে লঞ্চে তুলে নিয়ে গেল। তারা আর ফিরল না। বড় খালের দুপারের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিল। ভাল টিনের ঘর ভেঙ্গে নৌকা করে নিয়ে গেল লুটকারীরা। আমাদের বাড়ির সবাই ভদ্দর মিস্ত্রীর জঙ্গলে পালিয়ে থেকে কোনরকম বেঁচে গেলাম। আমাদের পরিবারের সঙ্গে ছিলেন আমার মেঝ ভগ্নিপতি, মেঝদিদি আর তাঁদের সদ্যজাত ১৭ দিনের শিশুপুত্র। আমার মেঝ ভগ্নিপতি ঢাকা শহরে চাকরি করতেন। ২৫ মার্চের পর কোনরকম প্রাণে বেঁচে গ্রামে চলে এসেছেন। লুটপাট, অগ্নিসংযোগ আর নিরীহ মানুষ হত্যা করে পাকবাহিনী আর তাদের দোসররা যখন চলে গেল তখন আমরা সবাই ভয়ে ভয়ে আমাদের চিরচেনা ঘরবাড়িতে ফিরে এসে দেখলাম কোথাও কিছু নেই। শূন্য ভিটামাটি পড়ে আছে। লুটকারীদের ফেলে যাওয়া সামান্য দু’একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে রাতের আঁধারে সেই নৌকাটিতে চড়ে কালীগঙ্গা নদীর ওপারে অপেক্ষাকৃত নিভৃত পল্লী ছৈলাবুনিয়া গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আমাদের জানা ছিল না বাংলায় তখন কোন নিরাপদ জনপদ নেই। বেশ বড় একটি বাড়ি। সাত আটটি পরিবার বাস করে বাড়িটিতে। একটি পরিবার কিছুদিন পূর্বে এদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। বাড়ির কর্তা ব্যক্তিরা পরামর্শ করে ঘরটি পরিষ্কার করে আমাদের কিছুদিন বসবাস করবার ব্যবস্থা করলেন। বাড়ির সবাই বুঝতে পারলেন সারাদিন আমাদের পেটে কিছু পড়েনি। ৯ জ্যৈষ্ঠ, ২৪ মের জঘন্য নৃশংসতম বিভীষিকাময় দিনটির করুণ স্মৃতি আজও আমাকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। সকাল ১১টায় পাকবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর একটি লঞ্চ কালীগঙ্গা নদীর তীরে গুয়ারেখা ইউনিয়নে এবং অন্য আর একটি লঞ্চ বেলুয়া নদীর তীরে দৈহাড়ী ইউনিয়নের দৈহাড়ী বাজারে ভিড়ল। পাকসেনা এবং তাদের দোসর রাজাকার মিলে প্রায় দু’শত হায়নার দল উনিশটি সংখ্যালঘু গ্রামে প্রবেশ করে যাকে যেখানে পেল সেখানেই গুলি চালিয়ে এবং বেয়নেট দিয়ে হত্যা করল। প্রায় তিনশত ছেলে, বুড়ো, যুবক ও মহিলা হত্যা করল হিংস্র নরখাদকের দল। শতশত ঘরবাড়ী, ফসলের গোলা, খড়ের গাদা, গরুসহ গোয়ালঘর, স্কুল, দোকান পেট্রল ও কেরসিন ঢেলে পুড়িয়ে দিল। এভাবে প্রায় সাড়ে তিনটা বা চারটা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ আর তা-ব চলল। গণকপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাছে এসে দেখলাম এক মর্মান্তিক দৃশ্য। সতেরজন নিরীহ গ্রামবাসীকে একটি মোটা দড়ি দিয়ে মালার মতো করে জড়িয়ে দড়ির দু’প্রান্ত দুটি নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে ব্রাশ ফায়ার করে মারল। এদের মধ্যে একজন গুলি খাওয়ার ভান করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বেঁচে গেল। সেই ভাগ্যবান মানুষটির নাম শ্রীবিনোদ বেপারী, কিছুদিন পূর্বে তিনি বয়োবৃদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। বৃষ্টি আর বাতাস শুরু হয়ে যাওয়ায় আগুনে আধাপোড়া ঘরবাড়ি শ্মশান ভূমির মতো মনে হচ্ছিল। মানুষ শ্মশানে দাহ শেষে শান্তিজল সিঞ্চন করলে নিবু নিবু চিতায় বাষ্প মিশ্রিত ধোয়া ওঠে তেমনি ঘরবাড়ির আগুন বৃষ্টির জলে অর্ধ নির্বাপিত হয়ে শ্মশান ভূমির রূপ ধারণ করল সমস্ত গ্রাম। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমি আমার অস্থায়ী পরবাসে এসে দেখলাম সবাই কান্না করছে। কারও আত্মীয়, কারও ছেলে, কারও বাবা, কারও মা পাকবাহিনী এবং তাদের দোসর দালালদের গুলিতে নিহত হয়েছে। আমার প্রিয় মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘তুই ফিরে এসেছিস কিন্তু তোর ছোট ভাই রতনকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।’ ভাইকে খুঁজে না পেয়ে আমার ভগ্নিপতি চারদিকে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিলেন। তিনি ভেবে ছিলেন মৃতদের ভিড়ে আমার ভাইকে খুঁজে পাবেন। আমাদের ভাগ্যের জোরে একটু পরে সবাইকে চমকে দিয়ে আমার ভাই কাদামাখা শরীর নিয়ে উপস্থিত হলো। এমন নৃশংসতা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি এসব সহজ সরল মানুষদের মৃত্যুর কারণ জেনে এবং তাদের মৃতদেহ দেখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম প্রতিশোধ নেবই নেব। রাতে ক্লান্তিতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার চোখে ঘুম নেই। রাতের আঁধারে হাতরে হাতরে আমার একটি জামা, একটি হ্যাফ প্যান্ট এবং একটি গামছা পুঁটলি বেঁধে ফেললাম। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে জন্মভূমি মাকে প্রণাম করে মুক্তিযুদ্ধে বেরিয়ে পড়লাম। দুপুর দুটা নাগাদ সাঁচিয়া বাজারে লঞ্চ স্টেশনে পৌঁছলাম। ছোট একটি বাজার তেমন কোন লোকজন চোখে পড়ল না। লঞ্চঘাটের পাশে একজন চায়ের দোকানির দেখা পেলাম। একটি রুটি আর কলা খেয়ে টিউবওয়েলের জলপান করে জনমানবহীন লঞ্চঘাটে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে হাসান সাহেবের কো¤পানির লঞ্চে চড়ে বসলাম। যাত্রী তেমন চোখে পড়ল না। টিকিট মাস্টার আমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন আমি কোন স্টেশনে যাব। মানিকদাহ স্টেশনে যাব একথা বলায় টিকিট মাস্টার আমাকে বললেন আমি যেন সাবধানে যাই কারণ গোপালগঞ্জে মিলিটারি ক্যা¤প আছে এবং মানিকদাহ লঞ্চঘাটে রাজাকার বাহিনী টহল দিচ্ছে। নতুন কোন মানুষ দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং কখনও কখনও ক্যা¤েপ ধরে নিয়ে যায়। মানিকদাহ ঘাটে সন্ধ্যা ছয়টায় পৌঁছলাম। লঞ্চঘাট একেবারে ফাঁকা। আমাকে এক চায়ের দোকানি জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করল আমি কোথায় যাব। আমি একটু কথা ঘুরিয়ে বললাম টেকেরহাট যাব। চায়ের দোকানি আমাকে এস্থান ত্যাগ করে তাড়াতাড়ি চলে যেতে বললেন। আমাকে তিনি বললেন, নদীর তীর ধরে হাঁটাপথে চলে যেতে। আমাকে তিনি গোপালগঞ্জ শহরের দিকে যেতে নিষেধ করলেন কারণ সেখানে মিলিটারি আছে। আমি নদীর তীর ধরে হেঁটে রাত আটটা নাগাদ ভেড়ারহাট বাজারে পৌঁছলাম। কাঠ বিক্রয় করে এমন একটি দোকানে গিয়ে এক বয়স্ক ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম রাতটুকু তার দোকানে কাটানোর জন্য। আমি অপরিচিত ছেলে বলে প্রথমে আমাকে তার ঘরে ঠাঁই দিতে রাজি হলেন না। পরে আমার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না আমার বিনীত ভাব দেখে। তিনি রাতে কিছু খাবার ব্যবস্থাও করলেন। বিশ্রাম করে ভদ্রলোককে বলে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করলাম। যখন হাঁটতে হাঁটতে ভেন্নাবাড়ী গেটের কাছে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে অন্ধকার, জনমানব শূন্য রাস্তা। নদীর জল এবং বিলের জলের সমতা রক্ষার জন্য কখনও গেট খুলে দেয়া হয় আবার কখনও বন্ধ করে রাখা হয়। আমি গেটের কাছে পৌঁছলে গেটম্যানের পরিবর্তে ঘর থেকে চারজন টগবগে যুবক বেরিয়ে এলেন, তাঁদের হাতে অস্ত্র। আমাকে তীব্রস¦রে দাঁড়াতে বললেন। আমি হাত মাথার ওপর তুলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শ্রদ্ধেয় মতি কমান্ডার আমাদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণের সময় শিখিয়েছিলেন আত্মসমর্পণের সময় মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যুবকগণের কথায় বুঝলাম তারা মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা আমাকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথা হতে এসেছি এবং কেন এসেছি ইত্যাদি। আমি এবার দৃঢ়ভাবে অথচ বিনয়ের সাথে বললাম বাড়ি হতে পালিয়ে এসেছি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করব বলে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দু’একজন আমার কথা শুনে হাসলেন একজন মজা করে বললেন, ‘তোমার এ শরীর নিয়ে রাইফেল তুলে তো যুদ্ধ করতে পারবে না।’ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তোমার দেশাত্ববোধ আর সাহস আমাদের যুদ্ধকে আরও উৎসাহিত করবে। আমার কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, ‘তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তুমি দেশে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করবে সেটি হবে তোমার কাজ।’ এদেশ থেকে যাদের ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতে পাঠানো হয়, তাদের অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে আমাদের পাঠাতে হয়। শারীরিক গঠন, দেশপ্রেমিক, সৎসাহসী, বিশ্বাসী, দেশের মুক্তিযুদ্ধে দরকারে আত্মবলিদানে কুণ্ঠিত হবে না এমন নির্ভীক তরতাজা যুবকদের আমরা নির্বাচিত করি। তোমার মধ্যে প্রায় সবকটি গুণ বিদ্যমান। শুধু শারীরিকভাবে তুমি অক্ষম বিধায় তোমাকে নির্বাচিত করতে পারছি না।’ রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁদের সাধারণ খাবার তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান এবং সুখী মানুষদের সুখ অনুভব করলাম। সকালে আবার বাড়ির পথে পা বাড়ালাম গোপন এবং আঁকাবাঁকা পথ ধরে। অনেক কষ্ট স¦ীকার করে এবং ঝুঁকি নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়ি ফিরে এলাম আমি। সবাই আমাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেললেন। বিশেষ করে আমার স্নেহময়ী মা। দিদির কাছে ক্ষমা চেয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাবার সময় না বলে নেয়া হারটি ফিরিয়ে দিলাম। দিদি কিন্তু এতটুকু রাগ করলেন না বরং বললেন মুক্তিযুদ্ধে যদি এ হারটি বিক্রির অর্থ ব্যয় হতো আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করতাম। এবার আমার বাবা একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সবাইকে একটি নিভৃত স্থানে ডাকলেন। আমরা সবাই একত্রিত হলে বাবার নেয়া সিদ্ধান্তটি আমাদের জানালেন। সিদ্ধান্তটি এরূপÑ আমার বাবা, মা, ছোট ভাই এবং আদরের সর্বকনিষ্ঠ বোনটি মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশেই থেকে যাবেন। তাঁরা কখনও থাকবেন স¦রূপকাঠীর পেয়ারা বাগান সংলগ্ন ব্রাহ্মণকাঠী গ্রামে আবার কখনও থাকবেন গোপালগঞ্জের মুক্তাঞ্চল সাতপাড় বিলাঞ্চলে আমার বড় দিদির বাড়িতে। আর আমি, আমার বেড়ে ওঠা কিশোরী বোনটি, মেঝ দিদি, মেঝ ভগ্নিপতি এবং আমার প্রায় তিন মাস বয়সী ভাগ্নেসহ শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেব। আমার পক্ষে সম্ভব হলো না মুক্তিযোদ্ধাদের দলপতি শ্রদ্ধেয় দাদার নির্দেশ রক্ষা করা। তিনি বলেছিলেন, ‘এ দেশে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করবার জন্য।’ আমার প্রিয় বাবার নির্দেশে আমাকে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হবে। এজন্য আমি মুক্তিযোদ্ধা দাদার কাছে দূর থেকে হলেও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তাঁর কথা পালন করতে পারব না বলে। চলবে... লেখক : গবেষক
×