ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রংপুর অঞ্চলের হাঁড়িভাঙ্গা আম

সুস্বাদু, রসালো- দেশ বিদেশে চাহিদা বেশ, চাষীরা খুশি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১২ জুলাই ২০১৬

সুস্বাদু, রসালো- দেশ বিদেশে চাহিদা বেশ, চাষীরা খুশি

তাহমিন হক ববী ॥ রংপুর অঞ্চলের হাড়িভাঙ্গা আমচাষীরা এবার লাভের মুখ দেখছেন। গত বছরের লোকসান এ বছর তারা পুষিয়ে নিচ্ছেন। বাজারে দিন দিন রসেভরা হাড়িভাঙ্গা আমের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াতে ভাগ্য ফিরছে আমচাষীদের। চাষীরা জানান, চলতি মৌসুমে বাম্পার ফলনের পাশাপাশি বাজারে ভাল দাম পাচ্ছেন তারা। তাই, চলতি মৌসুমের তারা মোটা অঙ্কের লাভের মুখ দেখেছেন। পাইকারি বাজারে প্রতি মণ হাড়িভাঙ্গা আম বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকায়। এর দাম আরও বেড়ে দ্বিগুণ হবে বলে জানিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। পাইকারি বাজারে উপরোক্ত দাম হলেও খুচরা বাজারে এর দাম আরও বেশি। ঈদে আমের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এক কেজি হাড়িভাঙ্গা আম গত কয়েকদিন ধরে কেজিপ্রতি ১৩০ টাকা থেকে দেড় শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত এক সপ্তাহের কিছু সময় আগেও খুচরা বাজারে এর কেজি ছিল মাত্র ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা। হাড়িভাঙ্গা আমের বড় মোকাম পদাগঞ্জ বাজারের চাষী ফিদ্দু মিয়া বলেন, গত মৌসুমে আম উৎপাদিত হয়েছিল কম। তার ওপর বাজারে দামও ছিল খুবই কম। তাই অনেক চাষী ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের লোকসান হয়েছে। এবার উৎপাদন বেশি, দামও পেয়েছি ভাল। মিঠাপুকুরের খোড়াগাছ, রানীপুকুর, ময়েনপুর, বালুয়া মাসিমপুর, বড়বালা, গোপালপুর, দুর্গাপুর ও পায়রাবন্দ ইউনিয়নের ৩ হাজারের মতো চাষী হাড়িভাঙ্গা আম চাষ করে থাকেন। এর সঙ্গে জড়িত পাইকারি ব্যবসায়ী রয়েছেন আরও প্রায় ২ হাজার। হাড়িভাঙ্গা আমচাষী আলহাজ আব্দুস সালাম সরকার জানান, রমজান মাসে আমের চাহিদা ছিল খুব বেশি। তখন প্রচুর আমদানিতে দাম কিছুটা কম ছিল। এখন দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাগানে এখনও বেশ আম রয়েছে। এরপরও চাহিদা থাকায় আমের ভাল দাম পাওয়া যাচ্ছে। আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, প্রতিমণ হাড়িভাঙ্গা আম বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকায়। দু’একদিনের মধ্যে দাম দ্বিগুণ হবে। অপর পাইকারি ব্যবসায়ী আকবর আলী জানান, বাজারে হাড়িভাঙ্গা এবার ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে। বেশি চাহিদা আর ভাল দাম গত বছরের লোকসান পুষিয়ে দিচ্ছে। আমচাষী ও পাইকাররা বলছেন, রংপুরের মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলায় উৎপাদিত হাড়িভাঙ্গা আমের বিক্রি এবার ২৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে পাল্টে এলাকার অর্থনীতি। হাড়িভাঙ্গা আমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় শিল্পপতিরা এসব এলাকায় জমি কিনে হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান করছেন। এই আম বিদেশেও রফতানি হচ্ছে হাড়িভাঙ্গা আমের সুমিষ্ট স্বাদের কারণে রাজশাহীর ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরসা, অরুনা, আম্রপালি, মল্লিকা, সুবর্ণরেখা, মিশ্রিদানা, নিলাম্বরী, কালীভোগ, কাঁচামিঠা, আলফানসো, বারোমাসি, তোতাপুরী, কারাবাউ, গোপাল খাস, কেন্ট, সূর্যপুরী, পাহুতান, ও ত্রিফলা আম বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষীরা রংপুর অঞ্চল থেকে হাড়িভাঙ্গা আমের চারা নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ওই এলাকায় চাষের চেষ্টা চালাচ্ছেন। রংপুরের পদাগঞ্জ ও বদরগঞ্জের স্টেশন বাজার এ অঞ্চলের হাড়িভাঙ্গা আমের বড় পাইকারি হাট। এই হাট থেকে প্রতিদিন ট্রাকে করে হাড়িভাঙ্গা আম নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। রংপুরের ফলের আড়ত ছাড়াও টার্মিনালের পশ্চিম কোণে বসেছে হাড়িভাঙ্গার মিনিহাট। এখান থেকেও পাইকাররা আম নিয়ে যাচ্ছেন। এ অঞ্চলের কুতুবপুর, খোড়াগাছ পাইকারের হাট, পদাগঞ্জ, কদমতলী, পীরের হাট, তালপুকুর, মাঠের হাট, আখড়ের হাট ছাড়াও সমস্ত এলাকা জুড়ে হচ্ছে এ আমের চাষ। এখানকার মাটি আম চাষের স¤পূর্ণ উপযোগী হওয়ায় ওই এলাকার চাষীরা অন্য ফসলের চেয়ে আমবাগানে সবচেয়ে মনোযোগী হয়ে উঠছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলায় এবার হাড়িভাঙ্গা আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ বছর ২৮০ কোটি টাকার আম উৎপাদিত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্যান বিশেষজ্ঞ খন্দকার মেজবাহুল ইসলামের মতে, রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৩ হাজার হেক্টর জমি হাড়িভাঙ্গাসহ বিভিন্ন আম চাষের আওতায় এসেছে। এক একর জমির বাগানে আম পাওয়া যায় দুই থেকে তিন মণ। চাষীরা ফরমালিন ছাড়াই এ বছর ভাল আমের ফলন পেয়েছেন। ফলের জগতে মিষ্টি, সুস্বাদু ও রসালো ফল হিসেবে আমের জনপ্রিয়তা সবার শীর্ষে। রসনার তৃপ্তি, শরীরের পুষ্টি যোগান, পরিবেশবান্ধব ও জাতীয় অর্থনীতিতে আমের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলার মানুষের প্রিয় আম ল্যাংড়া, ফজলি, গোপালভোগ, হিমসাগর, আশ্বিনাসহ আরও বহু প্রজাতির আম রয়েছে। এইসব ঐতিহ্যবাহী আমের পাশাপাশি বাংলার মাটিতে বিপুল সম্ভাবনাময় অপর আরেকটি আমের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এবং ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে যার নাম ‘হাড়িভাঙ্গা’। রংপুর এর মিঠাপুকুর উপজেলার ১০নং বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের আখিরাহাট সংলগ্ন খামারবাড়ীতে এ আমটির চাষ, ফলন ও সম্প্রসারণে পরিণত বয়সেও যে ব্যক্তিটি নিরলস ও অনবদ্য শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তিনি আলহাজ মোঃ আব্দুস সালাম সরকার। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বালুয়া-মাসিমপুর ইউনিয়নের জমিদারবাড়ির বাগানে প্রজাবৎসল, উদারমনা ও শৌখিন রাজা তাজ বাহাদুর শিংয়ের আমলে আমদানিকৃত ও রোপিত বিভিন্ন প্রজাতির সুগন্ধিযুক্ত ফুল ও সুস্বাদু ফলের বাগান ছিল, যা ১৯৮৮ সালের বন্যা ও ভাঙ্গনে যমুনেশ্বরী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ১নং খোরাগাছ ইউনিয়নের তেকানী গ্রামের মৃত নফল উদ্দিন পাইকার, পিতা মৃতঃ তমির উদ্দিন পাইকার আমের ব্যবসা করতেন। তিনি জমিদারের বাগানসহ অন্য আম চাষীদের আম পদাগঞ্জসহ বিভিন্ন হাটে বিক্রি করতেন। জমিদার বাগানের আমদানিকৃত আমের মধ্যে একটি আম খুবই সুমিষ্ট ও দর্শনীয় হওয়ায় তিনি এর একটি কলম (চারা) নিয়ে এসে নিজ জমিতে রোপণ করেন। বরেন্দ্র প্রকৃতির জমি হওয়ায় শুকনো মৌসুমে গাছের গোড়ায় পানি দেয়ার সুবিধার্থে একটি হাঁড়ি বসিয়ে ফিল্টার পদ্ধতিতে পানি সেচের ব্যবস্থা করেন কিন্তু অল্পদিনের ব্যবধানে কে বা কারা উক্ত হাঁড়িটি ভেঙ্গে ফেলেন। কালের বিবর্তনে বৃক্ষটি ফলবান বৃক্ষে পরিণত হয়। মৃত নফলউদ্দিনের পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও ভোক্তাবৃন্দ উক্ত গাছের আম খাওয়ার পর এত সুস্বাদু আমের উৎস সম্বন্ধে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, কে বা কারা যে গাছটির হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছিল এটি সেই গাছেরই আম। নফলউদ্দিনের মুখনিঃসৃত হাড়িভাঙ্গা কথার সূত্র ধরেই পরবর্তীতে এটি ‘হাড়িভাঙ্গা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০১০ সালে ৭ জুলাই হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান পরিদর্শন শেষে রংপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক বিএম. এনামুল হক মহোদয়ের ভাষায়-বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির আমের মধ্যে নতুন সংস্করণ ‘হাড়িভাঙ্গা’। নামের দিক থেকে তেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও স্বাদে-গন্ধে আমটি অনন্য বৈশিষ্ট্যম-িত। হাড়িভাঙ্গা আম গাছের চেহারা লক্ষ্যণীয় ও আকর্ষণীয়। ডগা বা ছায়নপুষ্ট ও বলিষ্ঠ। এর ছায়ন দ্বারা গ্রাফটিং করলে বা ডালে জোড়কলম লাগালের গাছ অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অল্প দিনের মধ্যে ডালপালা বিস্তৃত হয়ে গাছের পরিধি লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়ে যায়। চারা রোপণের পরবর্তী বছরেই মুকুল আসে, তবে প্রথম বছরে মুকুল ভেঙ্গে দিলে গাছের ডগার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হাড়িভাঙ্গা আম গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গাছের ডালপালা উর্ধমুখী বা আকাশচুম্বী হওয়ার চেয়ে পাশে বেশি বিস্তৃত হতে দেখা যায়। ফলে উচ্চতা কম হওয়ায় ঝড়-বাতাসে গাছ উপড়ে পড়ে না এবং আমও কম ঝরে পড়ে। আমটির উপরিভাগ বেশি মোটা ও চওড়া, নিচের অংশ অপেক্ষাকৃত চিকন। আমটি দেখতে সুঠাম ও মাংসালো, শ্বাস গোলাকার ও একটু লম্বা। আমের তুলনায় শ্বাস অনেক ছোট, ভিতরে আঁশ নেই। আকারের তুলনায় অন্য আমের চেয়ে ওজনে বেশি, গড়ে ৩টি আমে ১ কেজি হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি আম ৫০০/৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে। পুষ্ট আম বেশি দিন অটুট থাকে। চামড়া কুচকে যায় তবুও পঁচে না। ছোট থেকে পাকা পর্যন্ত একেক স্তরে একেক স্বাদ পাওয়া যায়।
×