ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অন্তরে দেখেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিঠোন-বুলবুলি দম্পতি

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৫ জুন ২০১৬

অন্তরে দেখেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিঠোন-বুলবুলি দম্পতি

চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে...। ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা, এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে...’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন বিখ্যাত গানটি। সেই গান বাস্তবে রূপ পেয়েছে বুলবুলি-মিঠোন দম্পতির পথ চলায়। মিঠোন ও বুলবুলি স্বামী-স্ত্রী। দু’জনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। চোখের আলো না থাকলেও মনের আলো জ্বালিয়ে সদা হাস্যোজ্জ্বল এ দম্পতি সব প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সংসার পেতেছে। সুখী এ দৃষ্টিহীন দম্পতি। রাজশাহীর পবা উপজেলার প্রত্যন্ত বেজোড়া গ্রামে এদের বাস। একটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করে সেখানেই বসবাস করেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হলেও তারা পথ চলেন, সংসারের সব কাজকর্ম করেন। রান্না-বাড়া ছাড়াও ঘর গৃহস্থালির কাজ সমানে সামলান তারা। জন্মান্ধ নয় এ দম্পতি। জন্মের তিন বছরের মাথায় অসুখে দৃষ্টি হারান মিঠোন। আর দেড় বছরের মাথায় বসন্ত হওয়ার পর দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন বুলবুলি। মিঠোন রাজশাহী নগরীর রাজপাড়া এলাকার নবগঙ্গা এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে। তার বয়স এখন ২৪ আর বুলবুলি পবার দারুশা এলাকার বেজোড়া গ্রামের শফিকুল ইসলামের মেয়ে। তার বয়স এখন ২৩। দুই বছর আগে ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল দু’জন নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করেন। নিজেরা এক কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করে সেখানেই ঘর বেঁধেছেন। দু’জনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় এলাকার সবাই এক নামে তাদের চেনে। রাজশাহী পল্লী বিদ্যুত সমিতি থেকে বিনামূল্যে তাদের ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে। এ দম্পতির খোঁজ নিতে রাজশাহী শহর থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে বেজোড়া গ্রামের বাড়ি গিয়ে তাদের পাওয়া গেল না। স্থানীয়রা জানালেন, কিছুক্ষণ আগে তারা পাশের দারুশা বাজারে গেছে। সেখানে গিয়ে তাদের খোঁজ নিতেই একজন জানালেন কৃষি ব্যাংকে আছেন তারা। সেখানে পাওয়া গেল এ দম্পতিকে। বিদ্যুতের বিল পরিশোধ ও প্রতিবন্ধী ভাতা তুলতে এসেছেন তারা। পরিচয় দিতেই হেসে ওঠেন। একসঙ্গে হাত ধরে বাইরে এলেন বুলবুলি-মিঠোন। তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল দৃষ্টিহীনতা কোন বাধাই নয়। দারুশা বাজারে হুজুরিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে বসে কথা হয় মিঠোন ও বুলবুলির সঙ্গে। মিঠোন বলেন, তিনি এখন লেখাপড়া করছেন। নওহাটা ডিগ্রী কলেজে ইতিহাসে অনার্সের ছাত্র। এর আগে শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন। মিঠোন ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ব্রেইল চেস্ট দাবা ফেডারেশনের সদস্য। সেখানে দাবা প্রতিযোগিতায় তার ডাক পড়ে মাঝে মাঝে। দাবা ভাল রপ্ত করেছেন তিনি। মিঠোন জানান, সেখানেই দাবা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে বুলবুলির সঙ্গে তার পরিচয়। দু’জনের বাড়ি একই এলাকা হওয়ায় সেখান থেকেই গড়ে ওঠে সম্পর্ক। এরপর দু’জনের ইচ্ছায় ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল তারা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। মিঠোন জানান, বিয়ের সময় দু’জনের পরিবারের কেউ জানতেন না। এখন সবাই জানে। তাদের মধ্যে অনেক মিল। একে অপরকে দেখতে না পেলেও পথ চলেন একসঙ্গে হাত ধরে। অন্তরের চোখে পরস্পরকে দেখেন। অবসরে ট্রেনে-বাসে সাধারণ জ্ঞানের বই বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন মিঠোন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিবন্ধী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও নিজেদের যুক্ত রেখেছেন। বুলবুলি বলেন, তারা দু’জন দু’জনকে বোঝেন। সব কাজে পরস্পরকে সহায়তা করেন। দেখতে না পেলেও মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন। কণ্ঠ শুনে পরিচিতজনদের চিনতে পারেন। কোন সমস্যা হয় না তাদের। শুধু চুলায় আগুন জ্বালাতে পারেন না বুলবুলি। সেক্ষেত্রে মিঠোন তাঁকে সাহায্য করেন। বুলবুলি স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন তবে বেশিদূর লেখাপড়া হয়নি। বাড়িতে বসে চার পারা কোরান শরীফ মুখস্থ করেছেন বুলবুলি। মিঠোন ও বুলবুলি বলেন, চোখের আলোয় দেখতে না পারলেও আলো-আঁধারি ও রাত-দিনের পার্থক্য তারা বুঝতে পারেন। সন্তান নিতে চান তারা। তবে নিজেরা সাবলম্বী হওয়ার পর। বুলবুলি বলেন, সরকারীভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য মাসিক ৫০০ টাকা করে পাচ্ছেন। এ টাকার পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি তাঁর। Ñমামুন-অর-রশিদ রাজশাহী থেকে
×