ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

শেখ হাসিনা, আপনিই তো বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৭ মে ২০১৬

শেখ হাসিনা, আপনিই তো বাংলাদেশ

দিনটি ছিল ১৭ মে, ১৯৮১। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে এলেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে। এদেশের ভাগ্যাকাশে যখন দুর্যোগের কালো মেঘের ঘনঘটা, ক্যু-হত্যা যখন নিত্যনৈমত্তিক, জাতি যখন নেতৃত্বশূন্য ও লক্ষ্যভ্রষ্ট, তখনই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। ওবায়দুল কাদের তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক। নেতা আসবেন, তাই তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য একমাস আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলাম। আমরা সংগঠিত করেছিলাম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। ১৫ আগস্টের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর রক্ত ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলাম এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব সৃষ্টি হবে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেব, ছাত্রলীগকে সংগঠিত করব। আমরা সারা বাংলাদেশের ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছিলাম। ছাত্রলীগের সকল নেতাকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জড়ো হয়েছিল সেদিন। তারপর সেখান থেকে আমরা গিয়েছিলাম বিমানবন্দরে, নেতাকে স্বাগত জানাতে। পুরো বিমানবন্দর এলাকা লোকে লোকারণ্য, যেন জনসমুদ্র। গণতন্ত্রের মুখোশধারী স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু আর অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে সেদিন জনসমুদ্র ছুটে এসেছিল প্রাণের নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে। সবার মুখে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান। হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি, রঙ্গিন পোস্টার, ব্যানার, নৌকার প্রতিকৃতি। সেই জনসমুদ্র দেখে আবেগে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। পিতা এবং তাঁর কন্যার প্রতি মানুষের এত গভীর ভালবাসা দেখে আবেগের অশ্রুকে রুদ্ধ করতে পারিনি সেদিন। আকাশ ছিল মেঘলা। নেত্রীকে এক নজর দেখার জন্য সবাই রানওয়ের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছিল। নিরাপত্তা বাহিনীকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। আমরা রানওয়ের ভেতরে ছিলাম। নেতাকে বয়ে আনা বিমান যে অবতরণ করবে সে জায়গাও ছিল না। সেদিন আমরা জনতাকে বহু কষ্টে সরিয়ে বিমান অবতরণের জায়গা করে দিয়েছিলাম। জাতির পিতার রক্তে ভেজা মাটিতে বিমান স্পর্শ করার খানিক পরেই আকাশ ভেঙ্গে নেমেছিল বৃষ্টি। বাংলার আকাশ বঙ্গবন্ধুর প্রাণপ্রিয় তনয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খুশিতে আবেগে অঝোরে কেঁদেছিল সেদিন। নেতাকে বহনকারী বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জনতার মিছিল যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে বহনকারী বিমান ছুঁয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেছিলেন অনেকেই। এর কিছুক্ষণ পর বিমানের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পুষ্পার্ঘ্যে শোভিত বঙ্গবন্ধুর কন্যা জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিবাদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গেই আনন্দ-বেদনায় কান্নার রোল ওঠে সমগ্র বিমানবন্দর এলাকাজুড়ে। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ সেøাগানের মাধ্যমে নেত্রীকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হচ্ছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম-পিতৃ হত্যার বদলা নেব’ সেøাগানটি। এই সেøাগানটির মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি, শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের তীব্র আবেগ ও ভালবাসা। মানুষের সেই তীব্র ভালবাসা দেখে শেখ হাসিনা নিজেও কান্না ধরে রাখতে পারেননি। এতদিন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ জমাট বেঁধেছিল বুকের ভেতরে, তা অশ্রুবিন্দু হয়ে দুচোখ বেয়ে নেমেছিল তাঁর। সেদিন তিনি পিতা-মাতা, ভাই-ভাবীসহ স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে শেরেবাংলা নগরের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘বাংলার জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি এসেছি, মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমি এসেছিÑ আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমি সামান্য মেয়ে। সক্রিয় রাজনীতি হতে দূরে থেকে আমি ঘরসংসার করছিলাম। কিন্তু সবকিছু হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ছোট ভাই রাসেলসহ সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাঁদের ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালী জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ সেদিন তাঁর সেই বক্তৃতা দিশেহারা আমাদের দিয়েছিল নতুন আলোর দিশা, নতুন জীবনের দিশা। তবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিভীষিকাময় বৈরী পরিবেশে স্বদেশের মাটিতে এসে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা ছিল অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু শেখ হাসিনার শরীরে প্রবাহিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী অকুতোভয় দেশপ্রেমিক শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনার এই পদ গ্রহণে সম্মতি প্রদান করা ছিল এক বিরল সাহসী পদক্ষেপ। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি তার চেয়েও বেশি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে শেখ হাসিনা এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেই তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন। সেই সময় থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে ফেরার পরদিন থেকেই শেখ হাসিনা একদিকে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও ভাবাদর্শগতভাবে সুসংবদ্ধ করে তোলার লক্ষ্যে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন। বহুধাবিভক্ত ব্র্যাকেটবন্দী আওয়ামী লীগকে জাতীয় মূল ধারার প্রধান দল হিসেবে গুছিয়ে তোলা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে দেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটিকে যুগোপযোগী করে তুলেছেন। আজ তাঁরই হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর মধ্য দিয়ে দেশ দায়মুক্ত, কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে। তাঁরই বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছার। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্র্বত্রই আজ উন্নয়নের জোয়ার। ডিজিটাল বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে আমরা। মানুুষের মুখে ফুটেছে হাসি। আজকের বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ভিত্তিমূল শেখ হাসিনার সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যেই রয়েছে। তিনি যদি দেশে ফিরে না আসতেন, হাল না ধরতেন, তবে বাংলাদেশ আবারও ফিরে যেত পাকিস্তানের করতলে। আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার দ্বারপ্রান্তে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর পরই ক্যারিশমেটিক নেতা হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হচ্ছে। কর্ম ও গুণের স্বীকৃতিস্বরূপ সাউথ সাউথ, চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থসহ বিভিন্ন পুরস্কারে তাঁকে ভূষিত করছে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। ধৈর্য ও সাহসের প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনা বহুমাত্রিক এক জ্যোতিষ্ক। তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর নেতৃত্বেই আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। সেজন্যই প্রয়াত কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই বলতে হয়, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’। আপনি দীর্ঘজীবী হোন। লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×