ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন রোগে আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান্ চিকিৎসার প্রয়োগ

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ১৫ মার্চ ২০১৬

বিভিন্ন রোগে আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান্ চিকিৎসার প্রয়োগ

অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না, সে সকল রোগ চিকিৎসায় একটি অত্যন্ত চমৎকার ও কার্যকর চিকিৎসা হিসাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন রোগ চিকিৎসায় স্বীকৃত আকুপাংচার (দেহের বিভিন্ন বিন্দুতে বিশেষ ধরনের এক প্রকার পিন ভেদ করিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রেখে চিকিৎসা করা) ও মক্সিবাশ্চান্ (বিশেষ বিশেষ ভেষজের তাপ প্রয়োগে) চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নত দেশসমূহে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে একটি স্থান দখল করে নিয়েছে। এটা একটি দর্শনভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যাতে মনে করা হয় যে এনার্জি আমাদের দেহে একটি প্রণালীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। যদি কোন কারণে এনার্জির উক্ত প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় বা এতে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয় তবে রোগের উদ্ভব ঘটে। আকুপাংচার দ্বারা উক্ত কারণসমূহ লাঘব বা অপসারণকরত এনার্জি প্রবাহকে পুনরায় স্বাভাবিক পর্যায় ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়। এতে দেহের প্রণালীর মাধ্যমে প্রবাহিত এনার্জির বাধা দূর বা প্রবাহ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আকুপাংচার বিন্দুতে বিশেষ ধরনের এক প্রকার পিন ভেদ করিয়ে নির্দিষ্ট মিনিট/ঘণ্টা পর্যন্ত রেখে চিকিৎসা করা হয়। আকুপাংচারের মাধ্যমে সৃষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ এনার্জি অথবা জৈব রাসায়নিক (ইরড়-পযবসরপধষ) সামঞ্জস্যতা দেহের নিজস্ব রোগ নিরাময়ক ক্ষমতাকে উজ্জীবিত করার মাধ্যমে সুস্থতা ফিরিয়ে আনে। আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান চিকিৎসার বৈশিষ্ট্যসমূহ: ১. এই চিকিৎসার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। ২. ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয় না, তাই ওষুধজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়। ৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়। ৪. এমন কিছু জটিল রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব যা অন্য কোন চিকিৎসা পদ্ধতিতে সম্ভব হয় না। তবে মনে রাখতে হবে যে রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী একজন আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান ডাক্তারেরর এই বিজ্ঞান সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা, পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকা একান্ত জরুরী। অপর্যাপ্ত শিক্ষা, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার অভাব নানা ধরনের গুরুতর সমস্যা সৃষ্টির কারণ হতে পারে। তাই অপ্রত্যাশিত জটিলতা প্রতিহত করার লক্ষ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যথাযথ শিক্ষিত আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান্ চিকিৎসক হতে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা উচিত। এই চিকিৎসা পদ্ধতি যদিও আমাদের দেশে আরম্ভ হয়েছে। তবে মেডিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিত আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম হওয়া ও এই চিকিৎসা পদ্ধতির রোগ বিশেষে প্রয়োগ সম্পর্কে রোগীদের যথেষ্ট ধারণা না থাকায় তারা ওই চিকিৎসার মাধ্যমে উপকৃত হওয়া থেকে বঞ্চিত আছেন। তাই বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান চিকিৎসা সম্পর্কে আমার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং চীনসহ বিভিন্ন দেশের গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ এখানে প্রদত্ত হলো বাত ও বিভিন্ন ব্যথা: আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান্ চিকিৎসার দ্বারা বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশের ডাক্তারদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে বিভিন্ন ব্যথায় আক্রান্ত প্রায় ৭০% রোগী উল্লেখযোগ্য ফল পান। হাঁটু, কোমর, ঘাড়, হাড়ক্ষয়, গোড়ালি, কাঁধসহ অন্যান্য ব্যথা সংক্রন্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৭০% রোগীর উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়। কখনও কখনও এই চিকিৎসা পদ্ধতি জাদুর মতো কাজ করে। মাথা ব্যথা: এই চিকিৎসা পদ্ধতি বিভিন্ন প্রকার মাথা ব্যথার চিকিৎসায় বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং খবুই ভাল ফল পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রকার মাথা ব্যথায় আক্রান্ত রোগীর মধ্য হতে ৬৫-৯৫% রোগী উল্লেখযোগ্য ফল পান। স্ট্রোক: স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে চাইনীজ গবেষকদের করা একটি গবেষণায় জানা গেছে যে প্রায় ৮০% স্ট্রোক আক্রান্ত রোগী এই চিকিৎসা পদ্ধতি দ্বারা উপকার পান। তাই বলা যেতে পারে যে, স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতির নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। স্নায়বিক ব্যথা: বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, ট্রাইজিমেনাল নিউরালজিয়া (চোয়ালব্যথা) আক্রান্ত প্রায় ৭০% রোগীর ব্যথা উপশম করতে এই চিকিৎসা কার্যকর। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্নায়বিক ব্যথার চিকিৎসায় এই পদ্ধতির প্রয়োগ অত্যন্ত ফলদায়ক। উদ্বিগ্নতা ও বিভিন্ন মানসিক অসুবিধা: অনিদ্রা, বিষন্নতা, ব্যবহারগত সমস্যা, উদ্বিগ্নতা, টেনশন, মনোযোগহীনতা, অ¯িহরতা ইত্যাদি সমস্যায় এই চিকিৎসা পদ্ধতি অতি কার্যকর। জটিল মানসিক রোগ-সিজোফ্রেনিয়ার ওপর করা একটি গবেষণায় চাইনীজ গবেষকদল দাবি করেন, উল্লেখযোগ্য (৫৪%) পরিমাণ রোগী আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান চিকিৎসা দ্বারা আরোগ্য লাভ করেছে। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এটা জানা যায় যে, এই চিকিৎসা পদ্ধতি উল্লেখযোগ্যভাবে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলে বিভিন্ন মানষিক চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে। নার্ভ প্যারালাইসিস: গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৫০%-৬০% রোগী এই চিকিৎসার ফলে উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষমতা ফিরে পান এবং মুখের প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ৭৫% রোগী আরোগ্য লাভ করেন। অটিজম, সিপি, ডাউন সিন্ড্রোম ইত্যাদি: ম¯িতষ্কের ক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে বাচ্চাদের মধ্যে সৃষ্ট অসুবিধাসমূহে এই চিকিৎসা বেশ কার্যকর। ফলাফল হিসাবে রোগীর সার্বিক উন্নতি হতে দেখা গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আকুপাংচার সহযোগে হার্বাল মেডিসিনের যৌথ ব্যবহারের ফলে অটিজম, সেরিব্রাল পালসি (সি-পি), ডাউন সিন্ড্রোম ইত্যাদি রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত চমৎকার ফল পাওয়া যাচ্ছে। বহু গবেষণাপত্রে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে ব্যখ্যা করা হয়েছে। আবার কিছু রোগী অল্পদিনের চিকিৎসায় আশ্চর্যজনকভাবে বেশ উন্নতি লাভ করেছে। আইবিএস: গবেষণা সমূহের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত যে আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান চিকিৎসা পদ্ধতি একটি নিরাপদ ও ওষুধবিহীন চিকিৎসা হিসাবে কার্যকরভাবে আইবিএস সমস্যার চিকিৎসা করতে পারে। অনেকেই চিকিৎসার প্রথম হতেই কার্যকারিতা উপলদ্ধি করতে পান। পার্কিনসন্স রোগ, মৃগী, স্নায়বিক বধিরতা ইত্যাদি: এ জাতীয় বিভিন্ন রোগেও আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান চিকিৎসা বেশ কার্যকর। গবেষণায় উক্ত রোগসমূহে ওই চিকিৎসার কার্যকারিতা লক্ষ্য করা গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতি বেশ চমৎকার ফল প্রদর্শন করে। হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, পুরাতন সর্দি ইত্যাদি: একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, হাঁপানি রোগে আক্রান্ত প্রায় ৭০% রোগী এই চিকিৎসা দ্বারা ভাল ফল পান। চিকিৎসাটি হাঁপানি রোগের প্রবণতা ও এর প্রকোপকে হ্রাস করতে সক্ষম। রোগীরা দীর্ঘ কাল রোগের আক্রামণ হতে মুক্ত থেকে সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ব্রঙ্কাইটিস আক্রান্ত প্রায় ৫০% এর উর্ধে রোগীরা এই চিকিৎসা দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। এই চিকিৎসা পদ্ধতিটি টনসিলাইটিস, সাইনোসাইটিস, ফ্যারাংজাইটিস, ল্যারিংজাইটিস, পুরাতন সর্দি, কানপাকা ইত্যাদি রোগেও অত্যন্ত কার্যকর। নেশা আসক্তি ও স্থূলতা: কিছু কিছু চমৎকার ফিজিওলজিক্যাল ও ক্লিনিকেল ফল ্এটা প্রমাণ করে যে স্থূলতা, ধূমপান ও অন্যান্য নেশার চিকিৎসার্থে আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান্ চিকিৎসা পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর । বন্ধ্যত্ব ও মহিলাদের রোগ : গর্ভধারণ ও অন্যান্য সমস্যায় আকুপাংচার ও মক্সিবাশ্চান্ চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োগ উন্নত দেশে আজ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যারা গর্ভধারণের সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য এই চিকিৎসাটি অত্যন্ত কার্যকর এবং হরমোন থেরাপি বা অন্য কৃত্রিম প্রক্রিয়ার মতো বিপজ্জনক বা বিরক্তিকর নয়। ডাঃ শারিক এইচ খান সহযোগী অধ্যাপক (ইনঃ)মেডিসিন সরকারী ইউনানী-আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মিরপুর-১৩, ঢাকা। আকুপাংচার চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ফোনঃ ০১৭১০-১৫৫৩৫৫
×