ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ জুন ২০২৫, ৯ আষাঢ় ১৪৩২

১৩৮ বছরেও পৌরসভার আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই, শহরের প্রবেশ দ্বারে ময়লার ভাগাড়

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ১৫:০৮, ২৩ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৫:০৮, ২৩ জুন ২০২৫

১৩৮ বছরেও পৌরসভার আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই, শহরের প্রবেশ দ্বারে ময়লার ভাগাড়

ছবি: জনকণ্ঠ

টাঙ্গাইল পৌরসভার বয়স প্রায় দেড়শ বছর। প্রাচীন পৌরসভায় নেই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বর্জ্য ফেলা হয় শহরের উত্তর-দক্ষিণের দুই প্রবেশ মুখে। এ কারণে দুই প্রবেশ মুখ হয়ে ওঠেছে ময়লার ভাগাড়। ওই ভাগাড়ের উৎকট দুগর্ন্ধে অতিষ্ঠ পথচারীরা। ফলে জনজীবনে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। তবে ময়লার ওই ভাগাড়েও আয়ের উৎস খুঁজে পেয়েছে ২০-২৫টি পরিবার।  

জানা যায়, বিগত ১৮৮৭ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত টাঙ্গাইল পৌরসভার আয়তন ২৯ দশমিক ৪৩ বর্গকিলোমিটার। বিগত ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় এক লাখ ৬৭ হাজার ৪১২ জন। তবে, উইকিপিডিয়া অনুসারে টাঙ্গাইল পৌরসভার মোট জনসংখ্যা তিন কোটি ২৮ হাজার ৭৮৫ জন। ১৮টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার এক লাখ ৪০ হাজার ২৩১ জন। প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় ১৩৮ বছরেও আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্থান গড়ে উঠেনি। নেই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। টাঙ্গাইল শহরের প্রবেশ পথ রাবনা বাইপাস ও কাগমারী শশ্মান ঘাট এলাকায় অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠেছে দুইটি ময়লার ভাগাড়। বাসাবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকের বর্জ্য ফেলা শহরের দুইটি প্রবেশ মুখে। ময়লার ভাগাড়ের উৎকট দুর্গন্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতায় প্রতিদিন শহরে আসা-যাওয়া করে অভ্যাগত শ’ শ’ নারী-পুরুষ এবং বৃদ্ধ-শিশুরা। অপরিকল্পিত ময়লার ভাগাড়ের জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে। দীর্ঘদিন ধরে খোলাস্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলনোয় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যও হুমকিতে। উৎকট দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা।

সরেজমিনে দেখা যায়, শহরের ময়লাগুলো পৌরসভার ভ্যানযোগে খোলাভাবে ফেলা হচ্ছে। বাসাবাড়ি ও ক্লিনিকের বর্জ্যে চরছে গরু। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা ময়লার স্তূপে খাবার কুড়াচ্ছে। যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে নাক চেপে যাচ্ছেন। পথচারীরা ওই এলাকায় এক মিনিটের জন্যও দাঁড়াতে পারছে না। ময়লার মধ্যে পড়ে আছে গরু-শুকরের মরদেহ। এরমধ্যেই টোকাইরা ময়লা থেকে কাঙ্খিত জিনিস খুঁজছে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের রাবনা বাইপাস ময়লার ভাগাড়ে কাজ করতে দেখা যায় ১৫-২০ জন টোকাইকে। শহরে প্রবেশের দক্ষিণপাশে কাগমারী শশ্মান ঘাটের উত্তরপাশে ময়লা ফেলা হচ্ছে। টাঙ্গাইলের নাগরপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ কাগমারী সড়কে যাতায়াত করে থাকে। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি এমএম আলী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীরা ওই পথেই চলাচল করেন।  

এদিকে, ময়লার ভাগাড়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি বাসাবাড়ি ও ক্লিনিকের বর্জ্য টানছে কয়েকশ মানুষ। ময়লার ভাগাড়ে টোকাইরা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে সারাদিন প্লাস্টিক, লোহা জাতীয় পরিত্যক্ত জিনিসপত্র কুড়াচ্ছে। ময়লার ভাগাড়ে ঘাঁটি গেড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা টোকাইরা। তারা সাপ্তাহিক ও মাসিক বেতনে কাজ করছে। 
ময়লার ভাগাড়ে বেতনভুক্ত শ্রমিক আল আমিন, সোনা মিয়া, আজমত, রোকন জানান, তারা সারাদিন ভাঙারি টুকিয়ে (সংগ্রহ করে) মাসে ১৫-১৮ হাজার টাকা বেতন পান। এ টাকা দিয়েই তাদের পরিবারের খরচ যোগানো হয়। পাবনা থেকে আসা টোকাই মনির জানান, তিনি ৭-৮ মাস ধরে এভাবেই ময়লার মধ্যে ভাঙারি (প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র) টুকান (সংগ্রহ করেন)। স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি তিনি লক্ষ করেন নাই। উৎকট দুর্গন্ধের মধ্যে দীর্ঘদিন কাজ করায় অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর কষ্ট গয়না, গা-সওয়া হয়ে গেছে।

সিরাজগঞ্জ থেকে আসা সোলাইমান জানান, সারাদিন ভাঙারি টুকিয়ে বিক্রি করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পান। নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে পারেন। নেত্রকোনা থেকে আসা সাইফুল জানান, দুর্গন্ধ গা-সওয়া হয়ে গেছে। তিনি প্রশ্ন করেন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিয়ে কি করবেন- আগে পেটতো বাঁচুক? এ কাজ না করলে তিনি ও তার পরিবার ডালভাতও খেতে পারবে না।  

এ বিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ জানান, টাঙ্গাইল পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল। রাবনা বাইপাস এলাকা এবং কাগমারী এলাকায় যেভাবে বর্জ্য ডাম্পিং করা হচ্ছে, তাতে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। শহরের দুই প্রবেশ পথে বর্জ্য ফেলার কারণে জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। খোলা স্থানে ডাম্পিং বন্ধ করে পৌরসভার নিজস্ব জায়গায় ডাম্পিং করার দাবি করেন তিনি। পরিবেশ রক্ষার্থে আইনি প্রয়োগ এবং শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পৌরসভাকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে বলে তিনি জানান।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রফেসর ডক্টর সাইফুল্লাহ জানান, উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য ফেলার কারণে দুর্গন্ধ ও রোগ জীবাণু ছড়ায়। শহরের প্রবেশ পথের ময়লার ভাগাড় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। অন্যদিকে, প্লাস্টিকের বর্জ্য নালায় ঢুকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. সুজাউদ্দিন তালুকদার জানান, খোলা ময়লা-আবর্জনা থেকে রোগ-জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে মানুষ ও পাখ-পাখালির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও ফুসফুসের বিভিন্ন জটিল রোগ হতে পারে। বায়ু দূষণের কারণে এলার্জি এবং এজমার সমস্যা প্রকট হচ্ছে। ফলে মানুষের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে পারে। বাতাসে ভারি ধাতু ছড়িয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে। ফলে লিভার-কিডনির রোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ছে।  

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক শিহাব রায়হান জানান, বিষয়টি তার নজরে এসেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের কাছে জায়গা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে কাজ শুরু হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন দ্রুতই ভোগান্তির সমাধান হবে এবং শহরবাসী একটি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পাবে। 

আবির

×