ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

একসঙ্গে তিন বন্ধুর মৃত্যু, রূপনগর টিলায় শোকের মাতম

ফিরোজ মাহমুদ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ১৬:৪৫, ২০ জুন ২০২৫

একসঙ্গে তিন বন্ধুর মৃত্যু, রূপনগর টিলায় শোকের মাতম

ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকার রূপনগর টিলায় এখন শোকের ছায়া। শুক্রবার (২০ জুন) দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত পরিবারের বসতিপূর্ণ এলাকায় একসাথে তিন তরুণের মৃত্যুর খবরে বইছে কান্নার রোল। কেউ হারিয়েছেন সন্তান, কেউ ভাই, কেউবা নাতি। প্রতিটি পরিবারেই চলছে আহাজারি।

জানা গেছে, নিহত তিনজন—আরাফাত, আনিস ও রিয়াজ—একই পাড়ার বন্ধু ছিলেন। কাজ করতেন বিএসআরএম কারখানায়। বৃহস্পতিবার রাতে কারখানায় যাওয়ার পথে ট্রেনের ধাক্কায় তাঁদের মৃত্যু হয়। জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের আরশিনগর ফিউচার পার্কের পেছনে চট্টগ্রামমুখী রেললাইনে ঘটে এই দুর্ঘটনা।

নিহতরা হলেন—দিদারুল আলমের ছেলে মো. আরাফাত (১৮), আবু তাহেরের ছেলে মো. আনিস (১৮) ও জিয়াউর রহমানের ছেলে মো. রিয়াজ উদ্দিন (১৮)। আনিস বিএসআরএম কারখানার গাড়িচালক এবং বাকি দুজন তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করতেন।

মধ্যম সোনাপাহাড় এলাকার রূপনগর টিলায় পাশাপাশি তিনটি টিনের ছাউনির ঘরে বাস করতেন এই তিন তরুণ। শুক্রবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তিন পরিবারের ঘরেই চলছে শোকের মাতম। আনিসের বিয়ের বয়স মাত্র ১৯ দিন। তাঁর স্ত্রী আহাজারি করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আবু তাহের ও মামা সিরাজুল ইসলাম ছেলের শোক সইতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।

আবু তাহের বলেন, “ছেলে আমার নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল মাত্র ১৯ দিন আগে। আজ তার নতুন গাড়িতে ওঠার কথা ছিল। এর আগেই সব শেষ।”

আরাফাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর নানি বিবি আমেনা ঘুম থেকে উঠে নাতির নাম ধরে কাঁদছেন। স্বজনদের কেউই তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না। দুই বছর বয়সে মা হারানো আরাফাতকে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন এই নানি।

রিয়াজ ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। কিছুটা উপার্জন করে সংসারে স্বস্তি ফিরিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে গেছে। বাবা জিয়াউর রহমান কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার শান্ত ছেলেটারে কেন নিয়ে গেলা আল্লাহ।”

ঘটনার সময় তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন একই এলাকার বাসিন্দা রায়হান হোসেন। তিনি জানান, চার বন্ধু মিলে রেলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। রায়হান সামনের দিকে থাকায় উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেন দেখে লাফ দিয়ে রক্ষা পান। কিন্তু বাকি তিনজন আর রক্ষা পাননি।

তিনি বলেন, “চট্টগ্রামমুখী লাইনে সাধারণত ট্রেন দক্ষিণমুখী যায়। তাই আমরা ভেবেছি সামনে থেকে ট্রেন এলে দেখতে পাব। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল শুনলেও গুরুত্ব দিইনি। মুহূর্তেই ট্রেন এসে ধাক্কা দেয়।”

এ বিষয়ে স্থানীয় দোকানি ইকবাল হোসেন বলেন, গত সোমবার থেকে ওই এলাকায় সব ট্রেন চট্টগ্রামমুখী লাইনে চলছিল। এ কারণে ট্রেন পেছন থেকে আসছে বিষয়টি বুঝতে পারেননি তরুণরা।

মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মো. এরশাদ উল্লাহ বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তিন তরুণের মৃত্যু হয়েছিল। তাঁদের শরীরে একাধিক আঘাত ও হাড় ভাঙার চিহ্ন ছিল।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, অমনোযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাটি নিয়ে একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

রেলস্টেশন মাস্টার আবু জাফর বলেন, খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানিতে রেললাইনের একটি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এক লেন দিয়ে ট্রেন চলছিল। তিনি আরও বলেন, “রেললাইনে মানুষের অবৈধ অবস্থান বাড়ছে। আড্ডা দেওয়া বা মোবাইলে কথা বলা বেআইনি। জনসচেতনতা ছাড়া এই ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকানো কঠিন।”

গতকাল দিবাগত রাত ৩টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তিন বন্ধুর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

আসিফ

×