
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষিপ্রধান অঞ্চলে চলছে বোরো ধান কাটার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। মাঠভরা সোনালি ধান ঘরে তুলতে কৃষক, কৃষিশ্রমিক এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গ্রামগুলো এখন মুখরিত। একদিকে যেমন কৃষকদের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, তেমনি কষ্টের ফসল ঘরে তোলার আনন্দও তাদের মাঝে স্পষ্ট।
বছরের পর বছর ধরে কৃষকদের নিরলস পরিশ্রমের ফল এই বোরো ধান। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই শুরু হয় ধান কাটার প্রস্তুতি। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কৃষকরা কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত, এমনকি অনেক সময় রাতের আঁধারেও আলো জ্বেলে ধান কাটছেন।
গ্রামীণ জনপদে এই সময়টায় এক উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। দলবদ্ধভাবে ধান কাটার দৃশ্য খুবই সাধারণ। একদল ধান কাটছে, অন্যদল সেগুলো আঁটি বাঁধছে, কেউ কেউ মাথায় করে বা গাড়িতে করে ধান বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধান কাটায় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশেষ করে, কম্বাইন হার্ভেস্টার যন্ত্রটি কৃষকদের শ্রম ও সময় দুটোই বাঁচাচ্ছে। এই যন্ত্র একসাথে ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের কাজ সম্পন্ন করে। এতে একদিকে যেমন শ্রমিক সংকট মোকাবিলা করা সহজ হচ্ছে, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি এড়িয়ে দ্রুত ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হচ্ছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ও কৃষকদের যন্ত্র ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
মানিকগঞ্জ জেলার বেতিলা মিতরা ইউনিয়ন, কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন এবং দিঘী ইউনিয়নে বুকজুড়ে এখন ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকরা। উৎসবমুখর কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর মাঠগুলো। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সময়মতো চাষাবাদ হওয়ায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। পরিশ্রমী কৃষকরা ভোর থেকে শুরু করে দিনভর ব্যস্ত থাকছেন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে।
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের এই ধানেই নির্ভর করে হাজার হাজার কৃষক পরিবারের জীবিকা। প্রতি বছর বোরো ধান কাটা শুরু হলে তৈরি হয় এক উৎসবমুখর পরিবেশ। এ সময় কৃষিকাজের পাশাপাশি দেখা যায় পারস্পরিক সহানুভূতি, সহযোগিতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অনন্য চিত্র।
ধান কাটা সফলভাবে শেষ হলে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠজুড়ে চলছে হাজারো কৃষকের ব্যস্ততা। কেউ কাটছেন ধান, কেউ মাড়াই করছেন, কেউবা গরুর গাড়ি, নৌকা ও ট্রলিতে করে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন সোনালি ফসল। সবমিলিয়ে প্রতিটি কোণ যেন গেয়ে উঠছে সোনালি ধানের গান। প্রতি বছরই এলাকাগুলোতে বোরো মৌসুমে দেখা যায় এক ধরনের কৃষি উৎসব।
এখানে দেখা যায় আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী সবার সহযোগিতায় দলবেঁধে ধান কাটেন কৃষকরা। মিলেমিশে কাজ করাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।
কৃষিকাজের এ দৃশ্য শুধু মৌসুমি নয়, এটি এক ধরনের আশা-ভরসার প্রতীক। প্রতি বছর এই সোনালি ফসলের ওপর নির্ভর করেই সামনে এগিয়ে চলে তাদের পরিবারের জীবনযাত্রা, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, সংসারের যাবতীয় খরচ এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
বেতিলা মিতরা ইউনিয়নের কৃষক সম্রাট বলেন, “এই ধানেই আমাদের জীবন। আল্লাহর রহমতে এবার ফলন ভালো হয়েছে। ধানের ভালো দাম পাইলেই আশা করি খরচ মিটাইতে পারব।”
তবে তবুও এখনো বেশিরভাগ এলাকাতেই ধান কাটা হচ্ছে হাতে বা ঐতিহ্যবাহী কৌশলে। এই ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলেই কৃষি এখন হয়ে উঠছে দেশের অন্যতম ভিত্তি।
মিমিয়া